রাশিয়ার জব্দ সম্পদ ইউক্রেনকে দেওয়ার উদ্যোগ ব্যর্থ, যৌথ ঋণে সম্মত ইইউ নেতারা
শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার জব্দ করা সম্পদ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতারা। রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে জোটের ভেতরে মতভেদ থাকায় বিকল্প পথে হেঁটেছে ইইউ। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঋণ করেই ইউক্রেনকে আগামী দুই বছরের জন্য প্রতিরক্ষা সহায়তা দেওয়া হবে।
ব্রাসেলসে দীর্ঘ আলোচনার পর শুক্রবার সকালে ইইউ সামিটের চেয়ারম্যান আন্তোনিও কস্তা সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, 'আজ আমরা ইউক্রেনকে ৯ হাজার কোটি ইউরো দেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছি। জরুরি ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজেট থেকে এই ঋণের জোগান দেওয়া হবে।'
ইইউ নেতারা ইউরোপীয় কমিশনকে রাশিয়ার জব্দ সম্পদের বিপরীতে 'রিপারেশন লোন' চালুর বিষয়ে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। তবে আপাতত সেই পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত বেলজিয়ামের আপত্তির কারণেই এই পথে হাঁটতে পারেনি ইইউ। কারণ, রাশিয়ার জব্দ সম্পদের সিংহভাগই রয়েছে বেলজিয়ামে।
ইইউর যৌথ ঋণের বিষয়টি প্রথমে অসম্ভব মনে হয়েছিল। কারণ, এর জন্য সব সদস্য দেশের ঐকমত্য প্রয়োজন। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান এর বিরোধিতা করে আসছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্র শর্ত সাপেক্ষে এই পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে রাজি হয়েছে। তবে তাদের শর্ত হলো, আর্থিকভাবে তাদের ওপর কোনো দায় চাপানো যাবে না।
ইইউ নেতারা জানিয়েছেন, ইইউতে রাশিয়ার ২১ হাজার কোটি ইউরো সম্পদ রয়েছে। রাশিয়া যতদিন না ইউক্রেনকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে, ততদিন এই সম্পদ জব্দই থাকবে। রাশিয়া যদি কখনও ক্ষতিপূরণ দেয়, তখন সেই অর্থ দিয়ে ইউক্রেন ইইউর এই ঋণ শোধ করতে পারবে।
জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, 'এটি ইউক্রেনের জন্য সুখবর আর রাশিয়ার জন্য দুঃসংবাদ। আমাদের উদ্দেশ্যও তাই ছিল।'
ইউক্রেনের জন্য এই অর্থ জোগাড় করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল। ইইউর সহায়তা না পেলে আগামী বছর অর্থসংকটে পড়ত কিয়েভ। এতে রাশিয়ার কাছে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হতো, যা ইইউর নিরাপত্তার জন্যও বড় হুমকি।
রাশিয়ার জব্দ সম্পদ ব্যবহারের বিষয়টি বেশ জটিল। ইউরোপে রাশিয়ার মোট জব্দ সম্পদের ১৮ হাজার ৫০০ কোটি ইউরোই রয়েছে বেলজিয়ামে। দেশটি আশঙ্কা করছে, এই অর্থ ইউক্রেনকে দিলে রাশিয়া আইনি ও আর্থিকভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে। এর বিপরীতে পর্যাপ্ত সুরক্ষা বা নিশ্চয়তা না পাওয়ায় বেলজিয়াম ঝুঁকি নিতে চায়নি।
সংবাদ সম্মেলনে বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী বার্ট ডি ওয়েভার বলেন, 'ক্ষতিপূরণ ঋণ (রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে) নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। তাই আমাদের প্ল্যান বি-তে যেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্তই টিকে রইল। ইইউ বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ এড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছে।'
ইইউর দেশগুলো এমনিতেই ঋণের ভারে জর্জরিত। এর মধ্যে ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে ইউরোপীয় কমিশনের সামনে দুটি পথ ছিল—রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহার করে ঋণ দেওয়া অথবা ইইউ বাজেটের বিপরীতে যৌথ ঋণ নেওয়া।
দ্বিতীয় পথটি বেছে নেওয়ায় হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান একধরনের 'কূটনৈতিক জয়' পেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, তিনি শুরু থেকেই রাশিয়ার সম্পদ ব্যবহারের বিরোধিতা করছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইইউর এক কূটনীতিক বলেন, 'অরবান যা চেয়েছিলেন, তা-ই পেয়েছেন। কোনো ক্ষতিপূরণ ঋণ হচ্ছে না। আবার হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়ার অংশগ্রহণ ছাড়াই ইইউ তাদের পদক্ষেপ নিচ্ছে।'
গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপীয় দেশগুলোকে 'দুর্বল' বলে খোঁচা দিয়েছিলেন। তাই ইইউ নেতাদের জন্য এবারের সম্মেলনে ইউক্রেনের অর্থায়ন নিশ্চিত করা ছিল মর্যাদার লড়াই। পাশাপাশি আগামী দুই বছর ইউক্রেন যাতে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য এই অর্থায়ন ছিল অপরিহার্য।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান কায়া কালাস বলেন, 'এখানে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই।'
সম্মেলনে অংশ নেওয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অবশ্য রাশিয়ার জব্দ সম্পদ ব্যবহারের পক্ষেই জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'রাশিয়ার আগ্রাসন রুখতে তাদের সম্পদ ব্যবহার করাই হতো সবচেয়ে স্পষ্ট ও নৈতিক সিদ্ধান্ত।'
