চট্টগ্রাম-০৪: বিএনপিতে তুমুল কোন্দল, ফাঁকা মাঠে জোর প্রচারণায় জামায়াত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রার্থী ঘোষণার পর চট্টগ্রাম-০৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ। দলটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও আলোচিত নেতা আসলাম চৌধুরীর মনোনয়ন প্রত্যাশিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তা পাননি। দলটির প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী সালাউদ্দিনের নাম। এই ঘোষণা আসার পর থেকেই আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
ফলে স্থানীয় বিএনপি এখন স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত। বিএনপির এই গৃহবিবাদের সুযোগে জোর নির্বাচনী কার্যক্রম ও প্রচারণা নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছে জামায়াতের প্রার্থী ও দলটির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার ছিদ্দিক চৌধুরী। ফলে হেভিওয়েট প্রার্থীর বিপরীতে নতুন মুখ নিয়ে ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত সীতাকুণ্ড উপজেলা ৭৬২.৪২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত। এখানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের বসবাস। মোট ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭২ জন। এরমধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২৫ হাজার ১৭ জন ও পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৫৩ জন।
মাঠ পর্যায়ে বিএনপিতে তুমুল কোন্দল
গত নভেম্বরে প্রথম দফায় বিএনপির প্রার্থী ঘোষণায় চট্টগ্রাম-০৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে কাজী সালাউদ্দিনকে মনোনয়ন দেওয়া হলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয়। উল্লেখ্য, একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় গত ৩ নভেম্বর দলটির প্রথম দফায় ঘোষিত ২৩৭টি আসনের তালিকায় এই আসনটি ছিল না। মূলত দলীয় অন্তঃকোন্দল থাকায় শুরুতেই তা ঘোষণা করা হয়নি। প্রায় একমাস পর গত ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফার ঘোষণায় আসনটিতে কাজী সালাউদ্দিনকে প্রার্থী করা হয়।
এই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী। এর আগে ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি দল মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। ফলে বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা মনোনয়ন না পাওয়ায় তার অনুসারীরা একাধিক কর্মসূচি পালন করছেন।
দলীয় সূত্রের তথ্যমতে, একসময় সীতাকুণ্ড ছাড়াও চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাজনীতিতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল আসলাম চৌধুরীর। বিএনপির রাজনীতিতে ২০১০ সালের পর তিনি 'রহস্য পুরুষ' হিসেবে খ্যাতি পান। শিক্ষকতা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, এরপর শিল্পপতি হিসেবে তার উত্থান হয়।
তবে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগসাজশে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে ২০১৬ সালের ১৫ মে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ৭৬টি মামলার বোঝা কাঁধে নিয়ে আট বছরের বেশি সময় ধরে জেলে ছিলেন তিনি। ওই সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হওয়ায় ঋণখেলাপি হন তিনি। গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। তবে এরপর থেকে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার বনিবনা হচ্ছিল না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (চাকসু) নির্বাচনে তার অনুসারীরা ছাত্রদলের প্যানেলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করে জয়ীও হয়। এছাড়া আসলাম চৌধুরী নিজে নতুন দল গঠন করবেন অথবা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে থাকবেন এমন নানা গুঞ্জনও মাঠে ছিল। সবমিলিয়ে দলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে আসলামের, যার প্রভাব পড়ে প্রার্থী ঘোষণায়।
স্থানীয় বিএনপির তথ্যমতে, দলীয় মনোনয়ন কাজী সালাউদ্দিন পেলেও নেতাকর্মীদের বড় অংশ এখনো আসলাম চৌধুরীর দিকে। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. কমল কদর থেকে শুরু করে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তার পক্ষ নিয়ে মাঠে আছেন। অন্যদিকে, কাজী সালাউদ্দিনের দিকে আছেন তার আপন ভাই ও উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব কাজী মহিউদ্দিনসহ একাধিক নেতা। তারা মাঠ পর্যায়ে পৃথক কর্মসূচিও পালন করছেন।
সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বরও পৃথক কর্মসূচি পালন করা হয়। বিজয় র্যালির ব্যানারে সীতাকুণ্ডে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার এলাকায় বিশাল মোটরবাইক শোডাউন দিয়েছেন আসলামের অনুসারীরা। অপরদিকে মাঠ ধরে রাখতে অঙ্গসংগঠনের কমিটিগুলো সালাউদ্দিন নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে মাঠ পর্যায়ে তুমুল কোন্দল ও বিরোধ বিরাজমান।
এ বিষয়ে বিএনপির প্রার্থী কাজী সালাউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '৯৫ শতাংশ নেতাকর্মী বিএনপি ও ধানের শীষের নির্বাচন করছেন। বাকি যারা এখনও বাইরে আছেন, তারাও দুয়েক দিনের মধ্যে প্রকাশ্যে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করবেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু নেতাকর্মীরা বিএনপির নির্বাচন করবেন। আগে ইউনিয়ন ভিত্তিক কাজ করেছিলাম, এখন কেন্দ্র ভিত্তিক কাজ করছি।'
এদিকে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তার ব্যক্তিগত সহকারী নুর উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'স্যার এখন মিডিয়াতে কথা বলছেন না।' তবে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর আসলাম চৌধুরী যে পরিস্থিতিতেই হোক, নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মাঠে জোর কার্যক্রম চালাচ্ছে জামায়াত
বিএনপির ঘরে যখন বিভক্তি, তখন চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সীতাকুণ্ড আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও দলটির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার ছিদ্দিক চৌধুরী জোর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এখনও মাঠ গুছাতে না পারলেও জামায়াত মনিটরিং সেল থেকে শুরু করে কেন্দ্র ভিত্তিক কমিটি গঠন করেছে। এছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করেছে দলটি। সাইকেল র্যালি থেকে শুরু করে জোর নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে আছেন তারা।
জামায়াত মনে করছে, আসলাম চৌধুরীর মতো হেভিওয়েট প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়লে এর সুবিধা তারা পাবে। দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধ থাকলে কাজী সালাউদ্দিনকে নির্বাচনী মোকাবিলা সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির বিরোধ সুবিধার কারণ হবে কি না জানতে চাইলে জামায়াতের প্রার্থী আনোয়ার ছিদ্দিক চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, '২০০৮ সালেও নির্বাচনের আগে বিএনপি তিন বার প্রার্থী পরিবর্তন করে আসলাম চৌধুরীকে দিয়েছিল। আমরা শুনছি, আসলাম চৌধুরীকে আবারও প্রার্থী করা হতে পারে। ফলে জামায়াত বিএনপির প্রার্থী নিয়ে চিন্তিত নয়। আমি গত এপ্রিল থেকে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছি, সাড়া পাচ্ছি। যা করণীয়, তা-ই করছি।'
এই আসনে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হয়েছেন আমেরিকার ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন এবং গণঅধিকার পরিষদের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আছেন নাসরিন আক্তার। এছাড়া এনসিপি থেকে তানজিদ রহমান, গণসংহতি আন্দোলন থেকে জাহিদুল আলম আল জাহিদ এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট থেকে আবুল আসাদ মো. জুবায়ের রেজভী নির্বাচনী মাঠে আছেন।
বিএনপির ঘাঁটি আসনটির ভোটের পরিসংখ্যান
সীতাকুণ্ড আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এখান থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) এবং ২০০১ সালে বিএনপির প্রার্থী এল কে সিদ্দিকী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ১৯৯৬ (জুন) ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ বি এম আবুল কাশেম (কাশেম মাস্টার) নির্বাচিত হয়েছিলেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবুল কাশেম ৫৪.০৬ শতাংশ এবং বিএনপির আসলাম চৌধুরী ৪৪.৭৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দিদারুল আলম ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এস এম আল মামুন নির্বাচিত হয়েছিলেন।
