জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিজেদের ডিএনএ বদলাতে শুরু করেছে মেরু ভালুকেরা: গবেষণা
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মেরু ভালুকদের ডিএনএতে পরিবর্তন আসছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বন্য কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে এটিই প্রথম কোনো গবেষণা, যেখানে ডিএনএ পরিবর্তনের বিষয়টি পরিসংখ্যানগতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
গবেষকেরা দেখেছেন, গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী মেরু ভালুকদের মধ্যে হিট স্ট্রেস, বার্ধক্য ও বিপাক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু জিনের আচরণে পরিবর্তন এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে তারা উষ্ণতর পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেরু ভালুকের অস্তিত্ব এখন ঝুঁকিতে। গবেষকদের আশঙ্কা, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মেরু ভালুক বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আর চলতি শতাব্দীর শেষে পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে প্রাণীটি।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার (ইউইএ) গবেষকেরা গ্রিনল্যান্ডের দুটি অঞ্চলের মেরু ভালুকদের রক্ত বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি চালিয়েছেন। তারা 'জাম্পিং জিন' এর দিকে বিশেষ নজর দেন, যা অন্য জিনের কার্যকারিতায় প্রভাব ফেলে। এদের শরীরে 'জাম্পিং জিন'-এর সক্রিয়তা অনেক বেশি। এই জিনগুলো ডিএনএর এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে গিয়ে অন্য জিনের কার্যকারিতা বদলে দিতে পারে।
গবেষণার প্রধান ড. অ্যালিস গডেন বলেন,'স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে এই ভালুকদের সক্রিয় জিনের তুলনা করে আমরা দেখেছি, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে দক্ষিণ-পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের ভালুকদের ডিএনএতে জাম্পিং জিনের সক্রিয়তা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।'
গবেষকদের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে বাসস্থান ও খাদ্যের উৎস পরিবর্তনের কারণে ভালুকদের বংশগতিতেও পরিবর্তন আসছে। তাদের দাবি, এই পরিবর্তনগুলো বোঝার মাধ্যমে ভবিষ্যতে মেরু ভালুকেরা কীভাবে উষ্ণ বিশ্বে টিকে থাকতে পারে, কোন প্রজাতিগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে এবং সংরক্ষণের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত—সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
ড. গডেন বলেন, 'বরফ গলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য একটি মরিয়া কৌশল হিসেবে গ্রিনল্যান্ডের উষ্ণতম অঞ্চলের মেরু ভালুকদের এই 'জাম্পিং জিন' ব্যবহার করে দ্রুত নিজের ডিএনএকে নতুন করে সাজানোর বিষয়টি এই প্রথম জানা গেল, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
উত্তর-পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা অনেক উষ্ণ এবং সেখানকার বরফস্তরও পাতলা। ডিএনএ সিকোয়েন্স সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। তবে জলবায়ুর দ্রুত উষ্ণ হওয়ার মতো পরিবেশগত চরম চাপের কারণে এই প্রক্রিয়া দ্রুততর হতে পারে।
গবেষকেরা ডিএনএতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন খুঁজে পেয়েছেন, যেমন—উষ্ণ পরিবেশে সাগরের বরফ গলে যাওয়ায় ভালুকেরা তাদের প্রধান খাবার সিল মাছ শিকার করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে তাদের ডাঙার কম চর্বিযুক্ত খাবারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে তাদের চর্বি হজমসংক্রান্ত জিনেও।
ড. গডেন বলেন, 'আমরা জিনে এমন কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছি, যেখানে জাম্পিং জিনগুলো অত্যন্ত সক্রিয়। এর মধ্যে কিছু জিনের অবস্থান প্রোটিন তৈরি হয় এমন জায়গায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে বাসস্থান বা বরফ গলে যাওয়ায় তারা দ্রুত মৌলিক জিনগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।'
পরবর্তী ধাপে বিজ্ঞানীরা বিশ্বজুড়ে থাকা মেরু ভল্লুকের ২০টি উপ-প্রজাতির ওপর গবেষণা করে দেখবেন, তাদের ডিএনএতেও একই ধরনের পরিবর্তন আসছে কি না।
গবেষকেরা বলছেন, এই গবেষণা মেরু ভল্লুকদের বিলুপ্তি থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো কমিয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে থামাতে না পারলে, তাদের বিলুপ্তির ঝুঁকি কোনো অংশে কমবে না।
ড. গডেন সতর্ক করে বলেন, 'আমাদের আত্মতুষ্ট হওয়া চলবে না। এই গবেষণা কিছুটা আশা দেখালেও, বিলুপ্তির ঝুঁকি থেকে ভল্লুকদের রক্ষা করা নিশ্চিত করে না। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ধীর করতে আমাদের যা যা করার, সবই করতে হবে।'
