সংসদ নির্বাচনে ইসির নিজস্ব রিটার্নিং কর্মকর্তা চায় রাজনৈতিক দলগুলো, যা বলছে কমিশন
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের দাবি জোরালো হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারাও এই দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় জানিয়েছে, এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি; কমিশন সভায় আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে।
আইন অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কমিশন চাইলে সরকারি কর্মকর্তা বা সমাজের যেকোনো ব্যক্তিকে এই পদে নিয়োগ দিতে পারে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনগুলো নিজস্ব কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালনা করলেও, জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে জেলা প্রশাসকদের (প্রশাসনের কর্মকর্তা) ওপরই নির্ভর করে আসছে।
রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের দাবি
গত ১৯ নভেম্বর ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, 'নির্বাচনে কয়েক লাখ নির্বাচন কর্মকর্তা প্রয়োজন। ইসির হয়তো পুরো জনবল নেই, কিন্তু যতটুকু আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। ৩০০ আসনে সরকারের কাছ থেকে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ধার না করে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের সাহস করে দায়িত্ব দিন। এতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে।'
তিনি প্রশাসনের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চারটি বোতাম থাকে—ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসি। সেখান থেকে এই বোতাম টিপেই ৩০০ আসনের ফলাফল বের করা হয়। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ইসিকে শক্ত হতে হবে।'
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল প্রতীক) চলতি মাসে ইসিকে লিখিত প্রস্তাবে জানিয়েছে, নির্বাচনকালীন প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত রাখতে ডিসি ও ইউএনওদের পরিবর্তে জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের যথাক্রমে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হোক।
বিশেষজ্ঞ ও সাবেক কর্মকর্তাদের মত
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং বর্তমান নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'যত দিন যাচ্ছে নির্বাচন ও রাজনীতি তত জটিল হচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বড় জেলা বা যেসব জেলায় আসন বেশি, সেখানে একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। অন্তত ১৪-১৫ জনকে এই দায়িত্ব দেওয়া সম্ভব। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমাদের নিজস্ব কর্মকর্তারা সেরা নির্বাচন উপহার দিয়েছিলেন।'
ইসি সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি বলেন, 'সময় এসেছে নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার। সবাইকে না দিলেও মিক্স (মিশ্র) করে দেওয়া যেতে পারে। কিছু জেলায় ডিসি এবং কিছু জেলায় ইসি কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। ইসি কর্মকর্তারা আইন ভালো জানেন এবং প্রয়োগ করতে পারেন। কেউ সঠিকভাবে কাজ না করলে কমিশন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, যা ডিসিদের ক্ষেত্রে সব সময় সম্ভব হয় না। সরকার বদল হলে ডিসিরা চলে যান।'
ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার না থাকার সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে জেসমিন টুলি বলেন, 'নির্বাচন কমিশন তখন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়ে ইসি কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে পারে।'
ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. জাকারিয়া পরামর্শ দেন, নিজস্ব কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিলে তা ফলপ্রসূ হতে পারে। আরেক সাবেক কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, 'ইসির দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিলে সরাসরি নিয়ন্ত্রণসহ সব কাজ সুচারুভাবে করা সম্ভব।'
ইসি কর্মকর্তাদের ক্ষোভ ও আগ্রহ
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর দায় নিতে নারাজ ইসির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, 'ভোটের দিন আমাদের কোনো ক্ষমতা থাকে না। ডিসিরা যা বলেন, আমরা তাই করতে বাধ্য হই। ভোটে আমাদের কাজ ছিল মূলত 'কামলা' দেওয়া, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতেন আমলারা। তাই বিতর্কিত নির্বাচনের দায় আমাদের নয়।'
বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক মনির হোসেন বলেন, 'কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা আন্তরিকতা ও গুরুত্বের সঙ্গে ভোট পরিচালনা করবেন। মাঠ পর্যায়ে আমাদের দক্ষ কর্মীবাহিনী রয়েছে।'
উল্লেখ্য, সাধারণত ইসি কর্মকর্তারাই ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত, প্রশিক্ষণ, মালামাল বিতরণসহ ভোটের যাবতীয় মাঠপর্যায়ের কাজ করেন। এমনকি রিটার্নিং কর্মকর্তা কারও মনোনয়ন বাতিল করলে সেই রায়ও লিখে দেন ইসি কর্মকর্তারা। কিন্তু চূড়ান্ত স্বাক্ষর ও সিদ্ধান্ত থাকে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে। ইসির হাতে বর্তমানে প্রায় ৮৬০ জন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা রয়েছেন।
কমিশনের বক্তব্য
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'ইসি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার বিষয়টি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সংলাপ শেষ হয়েছে, এখন কমিশনের মিটিং মিনিটস পাওয়ার পর কমিশন সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
