‘তুমি গেছ, কিন্তু তুমি আছ’ নিয়ান্ডারথালদের শেষ দিন...
তুষারের কণাগুলো ধীরে ধীরে নেমে আসছে; যেন আকাশ নিজেই ক্লান্ত হয়ে ফেলছে নিশ্বাস। চারপাশে সাদা নীরবতা, পৃথিবী যেন জমে আছে এক অনন্ত স্বপ্নে। পাহাড়ের কোলে খোদাই করা এক গুহার মুখে ঝুলছে হালকা কুয়াশা। ভেতরে টিমটিমে আলোয় জ্বলছে আগুন। তার শিখা লাল, নরম, কিন্তু জীবনের মতোই একগুঁয়ে। সেই আগুনের চারপাশে বসে আছে কিছু মানুষ–নগ্ন পাথরের ওপর ছড়ানো পশুর চামড়ায় জড়ানো শরীর, চোখে গভীর জ্যোৎস্নার মতো স্থিরতা।
বাইরে ঝড় উঠেছে, কিন্তু ভেতরে সেই আলোয় এক নিঃশব্দ উষ্ণতা। পুরুষটি ধীরে ধীরে শিকার করা পশুর হাড়ে ধারালো খুর বসিয়ে গোশত আলাদা করছে। পাশেই এক তরুণী তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছে আগুনের নাচ। আগুনের আলোয় তার মুখে ছায়া-আলো খেলা করছে, যেন সময়ের প্রথম প্রতিকৃতি। এক কোণে বসে এক বৃদ্ধ তার শক্ত আঙুলে কিছু দানা মাটি ঘষে ঘষে রং বানাচ্ছে। মাটির গন্ধ, আগুনের ধোঁয়া আর শ্বাসের উষ্ণতা মিশে তৈরি করছে জীবনের প্রাচীনতম শিল্প।
এক শিশু তার মায়ের কোল থেকে আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। উষ্ণতাকে অনুভব করে। মায়ের ঠোঁটে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি। শিশুর চোখে প্রতিফলিত হয় নড়তে থাকা শিখা, সেই আলোয় জেগে ওঠে পৃথিবীর প্রথম বিস্ময়–অস্তিত্বের বোধ। গুহার ছায়া-আলোর ভেতর দিয়ে তার হাতের ছায়া পড়ে দেয়ালে, হয়তো এটিই মানুষের ইতিহাসে প্রথম হাতের ছাপ। প্রথম প্রতীক।
তাদের মুখে ভাষা নেই। তবে দৃষ্টিতে আছে গল্প। তারা জানে না লিখতে। তবু জানে রেখে যেতে চিহ্ন–আগুনের ধোঁয়ায়, রঙের দাগে, বাতাসের শ্বাসপ্রশ্বাসে। এই মানুষগুলো নিয়ান্ডারথাল। পৃথিবীর প্রাচীন সন্তান। আমাদের হারানো আত্মীয়। তারা সময়ের অন্ধকারে আলো জ্বালিয়েছিল। নিছক বেঁচে থাকার জন্য নয় শুধু, টিকে থাকার অর্থ বুঝতে।
তাদের ঘিরে আছে অসীম নীরবতা, কিন্তু সেই নীরবতার ভেতরেই শোনা যায় মানুষের প্রথম স্পন্দন–শ্বাস, আগুন আর কৌতূহল। গুহার দেয়ালে প্রতিফলিত সেই শিখার দোলাই যেন ঘোষণা করছে, 'আমরা আছি।'
তারা জানে না ইতিহাস কী, জানে না ভবিষ্যতের নাম কী হবে, কিন্তু তাদের চোখের সেই আলোয় লেখা হয়ে গেছে মানবতার প্রারম্ভিক বাক্য।
আলো মানে জীবন। আগুন মানে আশা। আমরা, নিয়ান্ডারথালরা, সেই আলোর প্রথম রক্ষক। তারা ছিল পৃথিবীর প্রথম সভ্যতার স্থপতি। গুহার অন্ধকারে আগুন জ্বেলে তারা আলোর নাম শিখেছিল। তারা ছিল শিকারি। কারিগর। শিল্পী। আর একসময় মানুষেরই মতো স্বপ্নদ্রষ্টা।
ইতিহাসের এক অধ্যায়ে তারা হারিয়ে গেল। যেন সময়ের পাথরে গিলে ফেলল এক সম্পূর্ণ প্রজাতিকে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে শেষনিশ্বাস ফেলেছিল নিয়ান্ডারথাল জাতি। তারা বিলুপ্ত হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন বরফের চাদর পৃথিবীকে ঢেকে দিচ্ছিল। যখন নতুন মানুষ, হোমো স্যাপিয়েন্স দিগন্তে উঁকি দিচ্ছিল। নিয়ান্ডারথাল চলে গেল। কিন্তু আমাদের রক্তে রেখে গেল নিজেদের কিছু অণু। নিজেদের এক টুকরো ইতিহাস।
১৮৫৬ সালের গ্রীষ্ম। জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকায় কয়েকজন শ্রমিক চুনাপাথর খনন করছিল। হঠাৎ কোদালের আঘাতে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এল কিছু অদ্ভুত হাড়গোড়। প্রথমে ভেবেছিল, এটি হয়তো কোনো ভালুকের কঙ্কাল। কিন্তু হাড়গুলোর আকৃতি আলাদা। মাথার খুলি মানুষের মতো, কিন্তু পুরোপুরি নয়ও। পরে বিজ্ঞানীরা জানলেন, এটি মানুষ নয়, আবার সম্পূর্ণ পশুও নয়। এভাবেই পৃথিবী প্রথম জানল এক বিলুপ্ত প্রজাতির কথা–নিয়ান্ডারথাল। তার পর থেকেই শুরু হয় অনুসন্ধান। ইউরোপের পাহাড়, গুহা, নদী, মরুভূমি–সব জায়গায় বিজ্ঞানীরা খুঁজে বেড়ান সেই অজানা মানুষদের চিহ্ন। পাওয়া যায় পাথরের সরঞ্জাম, আগুনের ছাই, পশুর হাড়ে কাটা দাগ, গুহার দেয়ালে রঙের ছাপ। ধীরে ধীরে প্রতিটি টুকরো একত্র হয়ে তৈরি হয় এক বিশাল গল্প–মানুষের হারানো আদিম আত্মীয়দের গল্প।
মানুষের ইতিহাস শুরু আফ্রিকায়। কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে সেখানেই জন্ম নেয় প্রাচীন মানবগোষ্ঠীগুলো–হোমো হাবিলিস, হোমো ইরেক্টাস, হোমো হেইডেলবারগেনসিস। এদের এক শাখা উত্তর-পশ্চিমে গিয়ে ইউরোপে গড়ে তোলে নিয়ান্ডারথালদের। অন্যদিকে আফ্রিকার ভেতরেই জন্ম নেয় আধুনিক মানুষ–হোমো স্যাপিয়েন্স। নিয়ান্ডারথালদের জন্ম হয়েছিল প্রায় চার লক্ষ বছর আগে। তারা ঠান্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য তৈরি হয়েছিল ঘন পেশি, ছোট পা, প্রশস্ত বুক আর বড় চোখ। তাদের মাথা ছিল একটু লম্বাটে, মুখের সামনের অংশ বেরিয়ে ছিল, নাক ছিল বড় ও চওড়া। যাতে ঠান্ডা বাতাস সহজে গরম হয়ে ফুসফুসে ঢুকতে পারে।
তারা ছিল উচ্চতায় কম। কিন্তু শক্তিশালী। পুরুষদের গড় উচ্চতা ছিল প্রায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। নারীদের পাঁচ ফুটের কিছু বেশি। তাদের দৈনিক ক্যালরির প্রয়োজন ছিল চার হাজারের বেশি–কারণ, ঠান্ডায় বেঁচে থাকা মানেই আগুন, গোশত আর পরিশ্রমের জীবন। তারা ছিল প্রকৃতির সন্তান–প্রতিদিনের জীবনে ছিল শিকার, আগুন আর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা। তারা দলবদ্ধভাবে বাস করত। একটি দলে থাকত ২০ থেকে ৫০ জন মানুষ। শিশুদের যত্ন নিত সবাই মিলে। বৃদ্ধদের দেখা শোনা করত। আহত হলে সঙ্গীরা সহায়তায় এগিয়ে যেত। এসব আচরণ প্রমাণ দেয়, তারা ছিল মানবিক ও সামাজিক প্রাণী। নিছক প্রাণী নয়।
তাদের ঘর ছিল গুহা। আগুন ছিল তাদের আশ্রয় ও অস্ত্র–যা শীতের রাতে উষ্ণতা দিত। শ্বাপদ-হিংস্র পশু তাড়াত। খাবার সেদ্ধ করত। আগুনের চারপাশে বসে তারা গোশত পরস্পরের মধ্যে ভাগ করত। গল্প করত। নতুন সাজ-সরঞ্জাম বানাত। তাদের প্রযুক্তি ছিল উন্নত। তারা পাথর ভেঙে ধারালো খুর, ছুরি ও বর্শা বানাত। কাঠের দণ্ডে পাথর বেঁধে অস্ত্র তৈরি করত। কাঠের লাঠি এভাবে হয়ে উঠত অস্ত্রের হাতল।
ফ্রান্সের ল্য মুস্তিয় গুহায় পাওয়া তাদের সরঞ্জাম থেকে এসেছে 'মুস্তেরিয়ান সংস্কৃতি' নামটি। তাদের হাতিয়ার তৈরির কৌশল এত নিখুঁত ছিল যে আধুনিক প্রত্নবিদদের আজও বিস্মিত করে।
তারা পশুর চামড়া ঘষে ঘষে নরম করত। তা দিয়ে শরীর ঢাকত। হিম শীতল আবহাওয়ায় ওম পেত। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রমাণ মিলেছে পাথরের খুরে লেগে থাকা ক্ষয়ের দাগে। তারা ঠান্ডা মোকাবিলায় পোশাক পরত–মাথা, হাত, পা ঢেকে রাখত। এমনকি প্রতীকের চিন্তাভাবনাও তাদের ছিল। ইগলের নখর দিয়ে তৈরি অলঙ্কার, লাল রঙের রঞ্জক, পাথরের ওপর খোদাই করা চিহ্ন–সবই তুলে ধরে তারা শিল্প ও প্রতীকের ভাষা বুঝতে পারত। তারা মৃতদের দাফন করত। কখনো ফুল বা পাথর দিয়ে সাজাত। এ থেকে প্রমাণ মেলে, তাদের মধ্যে মৃত্যু ও জীবনের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হতো।
নিয়ান্ডারথালরা প্রধানত গোশত খেত। তবে তারা ফল, কন্দ, বাদাম, এমনকি মাছও খেত। এমআইটির ভূজীববিজ্ঞানী আইনারা সিসতিয়াগা বলেন, 'তারা মৌসুম অনুযায়ী খাবার বদলাত, যা পেত তা-ই খেত।' পরিবেশ বুঝে চলা বা এই অভিযোজনই তাদের সহনশীল করে তুলেছিল। তবে চরম পরিস্থিতিতে তারা নরখাদকও হয়েছিল। বেলজিয়ামের এক গুহায় পাওয়া হাড়ে কাটার দাগ প্রমাণ দেয় যে তারা নিজেদের মৃতদের মাংস খেয়েছিল–সম্ভবত আকালের সময়ে। এই ঘটনাগুলো শুনতে ভয়ানক। হয়তো গায়ের পশম খাড়া হয়ে ওঠে। পাশাপাশি প্রমাণ মেলে তাদের বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা। ১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর একটি জুনিয়র রাগবি দল ও তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের বহনকারী উরুগুয়ের বিমানবাহিনীর একটি বিমান আন্দিজ পর্বতমালার মাঝখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল। বিমানটিতে ৪০ জন যাত্রীসহ ৫ জন ক্রু সদস্য ছিল। ৭২ দিনের তীব্র ঠান্ডার মধ্য দিয়ে শুধু ১৬ জন শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তারা নিহত সহযাত্রীদের মাংস খেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে কথা প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়তেই পারে।
পাশাপাশি ইতিহাসের দিকে তাকাই, হ্যাঁ 'নরখাদক' শব্দটি শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে দুর্গম আফ্রিকার কোনো গোত্র কিংবা ভারতের অঘোরী বা কাপালিক সাধুদের ছবি। সভ্যতার আলোকবর্তিকা হাতে থাকা ইউরোপের কথা কজনই-বা ভাবি? এটা কল্পনা করাও কঠিন যে, একসময় সভ্য ইউরোপেই প্রচলিত ছিল শবদেহ খাওয়ার মতো প্রথা।
ঐতিহাসিক সত্য হলো, ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতেও মানুষের মৃতদেহ খাওয়ার চল ছিল ইউরোপে। 'শবের ভেষজগুণ আছে, আছে রোগ সারিয়ে তোলার আশ্চর্য ক্ষমতা', এমন বিশ্বাস থেকে তারা নির্দ্বিধায় খেত মানুষের মাংস, হাড়ের গুঁড়ো এমনকি করোটির অংশবিশেষ। আর এ 'নরমাংসভোজী'দের দলে ছিলেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজপরিবারের সদস্য, যাজক, এমনকি খোদ বিজ্ঞানীরাও!
নরখাদকদের নিয়ে মশকরাও আছে। এ ফাঁকে না হয় শোনেনি। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় এক ব্রিটিশকে পাকড়াও করে আফ্রিকার কোনো একটি নরখাদক গোষ্ঠী। ব্রিটিশটি সৌভাগ্যক্রমে তাদের ভাষা জানত। ফলে প্রাণে বেঁচে যায়। যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিল ব্রিটিশ। বলছিল, ভার্দুন সেক্টরে দৈনিক কয়েক হাজার সেনা মারা যায়। নরখাদকেরা অবাক হয়ে বলল, এত মানুষ খাও কেমনে? ব্রিটিশ বেশ গর্বিত স্বরে বলল, ছি ছি আমরা সভ্য। মানুষের মাংস খাই না। নরখাদকের সর্দার বলল, বাহ রে, আমরা আকালের সময় বাধ্য হয়ে দুয়েকটা মানুষ খাই, তাই আমরা হলাম অসভ্য। আর তোমরা হাজার হাজার মানুষ হত্যা করো কিন্তু খাও না। তোমরা হলে সভ্য!
তা যাগকে, প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় জন্ম নেয় হোমো স্যাপিয়েন্স। সময়ের সঙ্গে তারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে তাদের দেখা হয় নিয়ান্ডারথালদের সঙ্গে। তারা প্রথমে সহাবস্থান করে, তারপর সম্পর্ক গড়ে তোলে। তা সহবাস পর্যন্ত পৌঁছায়। জিন থেকে পাওয়া প্রমাণ বলছে, দুই প্রজাতি মিলিত হয়েছিল। তাদের সন্তান হয়েছিল, যারা আবার প্রজন্ম তৈরি করেছিল। আজ আফ্রিকার বাইরের মানুষের শরীরে এক থেকে চার শতাংশ নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ পাওয়া যায়। এই মিশ্রণ দেখায়, নিয়ান্ডারথালরা হারিয়ে গেলেও পুরোপুরি নয়। তারা আমাদের ভেতর বেঁচে আছে।
তাদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে নানা কারণ কাজ করেছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল প্রথম কারণ। 'আধুনিক মানুষের' এ দল ছিল বড়, সংগঠিত, আর তাদের অস্ত্র ছিল উন্নত। তারা দ্রুত শিখত, একে অপরের সঙ্গে তথ্য ভাগ করত, পরিকল্পনা করত। নিয়ান্ডারথালরা একা লড়ত। তাই পিছিয়ে পড়েছিল।
দ্বিতীয় কারণ ছিল জলবায়ুর ধাক্কা। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে ইউরোপের ধরাতলে এক সহস্রাব্দব্যাপী শীতল যুগ নেমে আসে। বন শুকিয়ে যায়, শিকার কমে যায়, নদী বরফে ঢেকে যায়। ছোট ছোট নিয়ান্ডারথাল গোষ্ঠী ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কেউ সরে যায় দক্ষিণে, কেউ মরে যায় ক্ষুধায়।
তৃতীয় কারণ ছিল তাদের সংখ্যা। তারা ছিল কম জনবহুল, প্রায় কয়েক শ বা হাজার জনের গোষ্ঠী। জন্মহার কমে যাওয়ায় বৃদ্ধি পাওয়ার আর সুযোগ ছিল না। জিনবৈচিত্র্যও হারিয়ে যায়। কিছু গোষ্ঠীতে আন্তআত্মীয় সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে দুর্বলতা বাড়ে, রোগ বেড়ে যায়, প্রতিরোধ ক্ষমতা যায় কমে। এই তিন বিপর্যয়–প্রতিযোগিতা, ঠান্ডা আর সংখ্যা–একত্রে নিয়ান্ডারথাল জাতিকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।
বরফ যুগে ইউরোপের তাপমাত্রা হঠাৎ নেমে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, মধ্য ইউরোপে এক হাজার বছরের ঠান্ডা যুগে নিয়ান্ডারথালদের অনেক গোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কৃষ্ণসাগরের উত্তর তীর ও ককেশাস অঞ্চলে তাদের কয়েকজন টিকে ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেও তারা হারিয়ে যায়। যেখানে হোমো স্যাপিয়েন্সরা পরিবেশের সাথে মিল রেখে জীবন কাটানোর ছন্দ গড়ে তোলে বা অভিযোজিত হয়ে দক্ষিণে আশ্রয় নেয়, নিয়ান্ডারথালরা থেকে যায় এবং প্রকৃতির ক্রোধের মুখে পড়ে, ব্যস! নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া চিরতরে।
সাইবেরিয়ার আলতাই পর্বতের দেনিসোভা গুহা নিয়ান্ডারথাল কাহিনির আরেক অধ্যায়। ২০০৮ সালে এখানে পাওয়া এক হাড়ের ডিএনএ বিশ্লেষণে নতুন মানবগোষ্ঠী, দেনিসোভানের সন্ধান মেলে। ২০১২ সালে পাওয়া যায় এক কিশোরীর হাড়, যার নাম দেওয়া হয় 'ডেনি'। বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেনির বাবা ছিলেন দেনিসোভান, কিন্তু শরীরে ছিল নিয়ান্ডারথাল জিনের ছাপ। আর মা ছিলেন সম্পূর্ণ নিয়ান্ডারথাল, যার উৎস ছিল পশ্চিম ইউরোপের ফ্রান্স-স্পেন অঞ্চল। অর্থাৎ নিয়ান্ডারথালরা শুধু আধুনিক মানুষের সঙ্গেই নয়, অন্য হোমিনিনদের সঙ্গেও মিশেছিল। এ থেকে প্রমাণ হয়, তারা শুধু হারিয়ে যায়নি, তারা বরং বিবর্তনের নদীতে মিশে গেছে নতুন স্রোতে।
আন্দালুসিয়ার আরদালেস গুহার দেয়ালে আজও দেখা যায় নিয়ান্ডারথালদের আঁকা রেখা। লাল ওখর, কালো কয়লা, আঙুলের ছাপ–সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নান্দনিকতা। তারা হয়তো প্রার্থনা করেছিল, হয়তো মৃত্যু স্মরণ করেছিল, হয়তো কেবল সৌন্দর্যের অনুশীলন করেছিল। এই চিত্রগুলো প্রমাণ করে, তারা চিন্তাভাবনা করতে জানত। তাদের অনুভব শক্তি ছিল। তারা ভাষা না জানলেও ভাব প্রকাশের উপায় জানত। তারা প্রথম মানুষ, যারা বলেছিল, 'আমরা আছি।'
আজ পৃথিবীতে প্রায় আট শ কোটি মানুষ। গবেষকেরা বলেন, এখন পৃথিবীতে যত নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ আছে, ইতিহাসে কখনো এত ছিল না। তারা বিলুপ্ত, তবু আমাদের প্রতিটি কোষে বেঁচে আছে। ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা, ঘুমের ধরন, রোগ প্রতিরোধ, ত্বকের রং–সব কিছুতেই লুকিয়ে আছে তাদের উত্তরাধিকার। তাদের হারিয়ে যাওয়া মানে নিখোঁজ হওয়া নয়। আসলে তা এক রূপান্তর। তারা অদৃশ্য হয়নি, মিলিয়ে যায়নি, তারা আমাদের অংশ হয়ে গেছে।
দূরদিগন্তে সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে, তুষারে ঢেকে থাকা পৃথিবী নরম সোনালি আলোয় জ্বলজ্বল করছে। বাতাসে জমে থাকা শীতের ভার যেন মাটির বুক থেকে নিশ্বাস তুলছে ধোঁয়ার মতো। সেই আলো-ছায়ার প্রান্তে হাঁটছে এক মানুষ–এক নিয়ান্ডারথাল পুরুষ। কাঁধে লম্বা বর্শা, পিঠে পশুর চামড়া, শরীরে শত যাত্রার ধুলো। তার নিশ্বাস ভারী, তবু সে থামে না। প্রতিটি পদক্ষেপে বরফ কচমচ শব্দ তোলে, যেন পৃথিবী নিজেই তার গল্প লিখছে পায়ের নিচে।
সে জানে না কোথায় যাচ্ছে। তার সামনে কেবল সাদা অসীমতা–কোনো গাছ নেই, কোনো পথ নেই, শুধু তুষার আর বাতাস। তবু তার চোখে একরকম জেদ–এক অদৃশ্য বিশ্বাস, যেন কোথাও আগুন জ্বলছে, কোনো গুহার ভেতরে কেউ অপেক্ষা করছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপ এক প্রতিজ্ঞা, যে যতই ঠান্ডা নামুক, হাওয়া হিমেল হয়ে উঠুক, আগুন নিভতে দেওয়া যাবে না।
তার চারপাশে পৃথিবী মৃতের মতো নিস্তব্ধ। তবু সেই নিস্তব্ধতায় শোনা যায় একটি হালকা স্পন্দন–হৃদয়ের মতো, যা মানুষ নামের গল্পের প্রথম তাল। মাথার ওপর ধূসর মেঘ, দূরে জমে থাকা বরফের দেয়াল, কিন্তু তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যের শেষ আভা। সেটি কেবল আলো নয়, এটি স্মৃতি, বেঁচে থাকার প্রতীক।
হঠাৎ সে থামে। তার সামনে এক ছোট নদী, আধা বরফ, আধা জল। সে হাঁটু গেড়ে বসে, হাতের তালুতে বরফের গুঁড়া তুলে মুখে মাখে। হয়তো তৃষ্ণা মেটায়, হয়তো ক্লান্তি মুছে ফেলে। তারপর নিচের জমিতে তার হাত রাখে–সেই হাত, যেটি একদিন গুহার দেয়ালে প্রথম চিহ্ন এঁকেছিল। সেই চিহ্ন, যা হাজার বছর পরে মানুষ চিনবে নিজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
তার চারপাশে ঘুরছে বাতাস, হালকা ধুলো উড়ছে। সে চোখ বন্ধ করে যেন শুনছে কিছু–হয়তো কোনো নারীর কণ্ঠ, কোনো শিশুর হাসি, হয়তো জলন্ত আগুনের শো শো আওয়াজ। সে একা, তবু একা নয়। তার ভেতর দিয়ে এখনো বয়ে যাচ্ছে তার গোষ্ঠীর প্রতিধ্বনি, যারা গুহায় আগুনের চারপাশে বসে গল্প বলত, যারা রং মিশিয়ে দেয়ালে রেখা টানত। তারা আর নেই, কিন্তু তাদের স্বপ্ন এখনো জীবিত তার রক্তে।
সে আবার হাঁটা শুরু করে। পেছনে পড়ে থাকে তার পায়ের ছাপ, বরফে ছাপা এক ইতিহাস। প্রতিটি পদচিহ্ন যেন একটি শব্দ, একটি বাক্য–যা মিলিয়ে গিয়ে নতুন গল্প হয়ে ওঠে। এক সময় তার পায়ের দাগ ঢেকে দেয় তুষার, কিন্তু পৃথিবী তা ভোলে না। সেই পথের ওপর দিয়েই বহু সহস্র বছর পরে নতুন মানুষ হাঁটবে। তারা আগুন জ্বালাবে, গান গাইবে, শহর গড়বে, আকাশে উড়বে। মহাকাশ বিজয় করবে। গ্রহালোকে সফরে নামবে। সাগরের তলে খতিয়ে দেখবে। কিন্তু সেই সবকিছুর ভেতরে থাকবে এই মানুষের অদৃশ্য হাত।
সে যখন দূরে মিলিয়ে যায়, সূর্য তখন পুরোপুরি ডুবে গেছে। আকাশে জমে থাকা ধূসর মেঘে প্রতিফলিত হয় তার ছায়া। কোথাও আগুনের মতো এক বিন্দু আলো ঝলসে ওঠে–হয়তো কোনো গুহার গভীরে, হয়তো কোনো স্মৃতির ভেতরে। পৃথিবী যেন নিঃশব্দে বলে ওঠে, 'তুমি গেছ, কিন্তু তুমি আছ।'
নিয়ান্ডারথাল পুরুষটি হয়তো জানত না, তার শেষনিশ্বাসই এক নতুন যুগের শুরু। তার রক্তের কণায় যে আগুন ছিল, সেটিই একদিন আধুনিক মানুষের চোখে পরিণত হবে। তার আঁকা প্রতীক থেকে জন্ম নেবে ভাষা, তার শিকার কৌশল থেকে বিজ্ঞান, তার আগুন থেকে সভ্যতা।
আজ কোটি বছর পরেও আমরা যখন হাত বাড়িয়ে আগুন ছুঁই, তখন সেই একই আগুনের স্মৃতি জেগে ওঠে। যখন আমরা ভালোবাসা, বেদনা, কিংবা স্বপ্নের কথা বলি, তখন তারই উত্তরাধিকার ফিসফিস করে আমাদের ভেতর। সে হয়তো হারিয়ে গেছে বরফের নিচে, কিন্তু তার চিন্তা বেঁচে আছে শব্দে, তার প্রতিরোধ বেঁচে আছে হৃদয়ে।
তার পায়ের দাগের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা তৈরি করেছি ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়। আমরা গড়েছি শহর, লিখেছি কবিতা, উড়েছি নক্ষত্রের দিকে–কিন্তু শুরুটা সেখানেই, সেই বরফের প্রান্তরে, সেই মানুষের হাতে।
নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়নি। তারা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে–আমাদের শরীরে, আমাদের জিনে, আমাদের কল্পনায়। তারা বেঁচে আছে প্রতিটি চোখে যেখানে জেদ আছে, প্রতিটি হাতে যেখানে আগুন আছে, প্রতিটি হৃদয়ে যেখানে এখনো ভয় আর আশার টানাপোড়েন চলছে।
তাদের গল্প শেষ হয়নি। তারা এখনো হাঁটছে–আমাদের স্বপ্নের মধ্যে, আমাদের ইতিহাসের ভেতর, আমাদের প্রতিটি শ্বাসে।
তুষারের নিচে তাদের পদচিহ্ন মুছে গেলেও পৃথিবী এখনো সেই পথে আলো রাখে। কারণ, সেই আগুন, যা এক নিয়ান্ডারথালের হাতে প্রথম জ্বলেছিল, আজও নিভে যায়নি। তারই শিখায় জ্বলছে আমাদের সব নাম, আমাদের সব গল্প, আর সেই প্রথম উচ্চারণ–আমরা আছি। আমরা এখনো বেঁচে আছি।
