বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পোশাক রপ্তানিতে বিপুল অদৃশ্য ক্ষতি: শিল্পনেতারা
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিদেশে রপ্তানি আদেশ হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন দেশের পোশাক শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা। এতে আগে থেকেই চাপের মধ্যে থাকা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাত আরও সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
রোববার (২ নভেম্বর) রাজধানীতে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বাইং হাউস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত 'বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান সংকট ও উত্তরণের পথ' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় শিল্পনেতারা বলেন, বিমানবন্দরের এই অগ্নিকাণ্ড নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সভায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, "বহির্বিশ্ব থেকে তারা ভাববে—যে দেশে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুড়ে যায়, সেখানে অর্ডার দেওয়া নিরাপদ নয়। আমাদের কারখানা পুড়ছে, ঘরবাড়ি পুড়ছে, এখন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও পুড়েছে। দৃশ্যমান ক্ষতির চেয়ে অদৃশ্য ক্ষতি আরও বেশি, যা খালি চোখে দেখা যাবে না।"
তিনি আরও বলেন, "ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে, ব্যাংক বন্ধ হচ্ছে—আপনারা নির্বাচন দিয়ে আমাদের মুক্তি দিন, আমরা শান্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চাই।"
ক্রেতাদের আস্থা কমে যাওয়ার শঙ্কা
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বাইয়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, "বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ব্যবসা আজ হুমকির মুখে। ক্রেতারা এখন আর আস্থা পাচ্ছে না—ভবিষ্যতে অর্ডার দেওয়া পণ্য সময়মতো পাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছে। এ কারণেই তারা বাড়তি দাম দিয়েও অন্য দেশে অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছে।"
তিনি জানান, "এখন পর্যন্ত প্রায় ২৫০টি কারখানা বন্ধ হওয়ার মুখে।"
একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, "আগুনে যে অর্ডারের স্যাম্পল পুড়ে গেছে, তার কারণে পরবর্তী মৌসুমের ব্যবসা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আবার যে এক্সেসরিজগুলো পুড়েছে, তার দাম হয়তো দুই হাজার ডলার, কিন্তু এর ফলে বিশ হাজার ডলারের ব্যবসা হাতছাড়া হবে।"
তিনি আরও জানান, "ঢাকা বিমানবন্দরে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এখনো কুরিয়ার সার্ভিসগুলো সঠিকভাবে আমদানিকৃত পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। আমরা (বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ) আর্থিক সহায়তা দিয়ে টেন্ট স্থাপন করেছি, কিন্তু জটিলতার কারণে কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো পণ্য প্লেস করতে পারছে না। ফলে তারা সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারছে না।"
চরম চাপের মুখে পোশাক শিল্প
বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "গত তিন মাস ধরে অর্ডার কমছে। অথচ সরকারের কোনো নীতিগত সহায়তা পাইনি।"
তিনি উল্লেখ করেন, "বর্তমান পরিস্থিতি কোভিড সময়ের চেয়েও খারাপ। অনেক কারখানা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ক্লাসিফায়েড হয়ে যাচ্ছে।"
২০ জন শ্রমিক দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ সংক্রান্ত সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি বলেন, "এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় বয়ে আনবে।"
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ 'অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণে' ভুগছে, যা উদ্যোক্তাদের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, "বিএনপি ক্ষমতায় এলে আমরা পুনরায় ডিরেগুলেশনের দিকে যাব, যদিও তা কষ্টকর হবে।"
'প্রেস সচিব উম্মাদের মতো কথা বলেন'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, "প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উম্মাদের মতো কথা বলেন। তার একটা ফেসবুক পেজ আছে—ওখানে উল্টোপাল্টা কথা বলে মানুষকে বিব্রত করেন। সঠিক লোক যদি সঠিক জায়গায় না থাকে, তাহলে সঠিক সিদ্ধান্তও আসবে না।"
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবুর বৈঠকের সময় না পাওয়ার সাম্প্রতিক অভিযোগের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, "দুঃখের বিষয়, এখনো বিজিএমইএ সভাপতি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে একটি বৈঠকও করতে পারেননি। তাহলে আপনি (প্রধান উপদেষ্টা) এ দায়িত্ব নিলেন কেন?"
তিনি আরও বলেন, "বিগত সরকারের সময় যেসব নাটক-খেলাধুলা হয়েছে, এখন আবার সেই একই দৃশ্য শুরু হয়েছে।"
শফিকুল আলমকে উদ্দেশ্য করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "আমরা সবাই মরছি, ফ্যাক্টরি বন্ধ হচ্ছে, মানুষ চাকরি হারাচ্ছে—আপনি কি এসব দেখেন না?"
তিনি আরও বলেন, "যে দেশে বিমানবন্দর পুড়ে যায়, সেখানে বিদেশি ক্রেতারা কি অর্ডার দেবে? এই অদৃশ্য ক্ষতির প্রভাব অনেক গভীর।"
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের মুক্তি দিন।"
