'আমরা হারিয়ে যেতে চাই না': জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রে তলিয়ে যেতে থাকা টুভালুর টিকে থাকার লড়াই

টুভালুর জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মাইনা তালিয়া আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, তার দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়ছে এবং অন্য দেশগুলো থেকে 'বাস্তব প্রতিশ্রুতি' প্রয়োজন, যাতে টুভালুর জনগণ তাদের দেশে থাকতে পারে।
প্রশান্ত মহাসাগরে অস্ট্রেলিয়া ও হাওয়াই মাঝামাঝি অবস্থিত এই ছোট দেশটি নয়টি প্রবালদ্বীপ ও দ্বীপ নিয়ে গঠিত। জলবায়ু পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হওয়ার কারণে দেশটি বর্তমানে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন পথ খুঁজছে। কিন্তু এখন টুভালুর জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো, পানির নিচে তলিয়ে না যাওয়া।
নাসার বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে টুভালুর প্রধান প্রবাল দ্বীপ ফুনাফুটির অর্ধেক অংশ সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে। টুভালির ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা এই দ্বীপে বসবাস করেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পাবে হিসাবে ধরে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যদু উচ্চতা ২ মিটার বৃদ্ধি পায়, তাহলে ফুনাফুটির ৯০ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে টুভালুর গড় উচ্চতা মাত্র ২ মিটার (৬ ফুট ৭ ইঞ্চি)। গত ৩০ বছরে এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ ১৫ সেন্টিমিটার (৬ ইঞ্চি) বেড়েছে, যা বিশ্বজুড়ে গড়ের ১.৫ গুণ। দেশটি ইতোমধ্যেই ৭ হেক্টর (১৭ একর) কৃত্রিম জমি তৈরি করেছে এবং আরও নতুন জমি তৈরির পরিকল্পনা করছে, যা ২১০০ সাল পর্যন্ত ঢেউইয়ের ওপরে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মাইনা তালিয়া আল জাজিরাকে বলেন, 'আমাদের দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটার উপরে। তাই জমি পুনরুদ্ধার, সমুদ্র প্রাচীর নির্মাণ এবং সহনশীলতা গড়ে তোলা আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার।'
তিনি বলেন, 'আমরা আর সময় নষ্ট করতে পারি না। টুভালুর বাঁচার জন্য জলবায়ু অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি। এটি আগামী দুই-তিন বছরের জন্য নয়, এখনই প্রয়োজন যাতে আমরা জলবায়ু সংকটের মোকাবিলা করতে পারি।'
তালিয়ার টুভালুর গৃহ ও পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্বও, পালন করছেন। তিনি জানিয়েছেন, অর্থায়নের বিষয়টি নভেম্বর মাসে ব্রাজিলের আমাজনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘের 'কপ৩০' জলবায়ু সম্মেলনে মূল বিষয় হয়ে থাকবে।
'যে দূষণ করে, সে দায়ভার বহন করবে'
টুভালু এবারের কপ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নে একটি ভালো চুক্তির জন্য জোর দিচ্ছে। গত বছর আজারবাইজানে অনুষ্ঠিত কপ সম্মেলনে ধনী দেশগুলো মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করায় অনেক সমর্থক হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন।
তালিয়া বলেছেন, কপ জলবায়ু সম্মেলন এখন যেন 'তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর উৎসব' হয়ে উঠেছে। তাই টুভালু বিকল্প উদ্যোগও অনুসন্ধান করছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রথম জীবাশ্ম জ্বালানি নন-প্রোলিফারেশন চুক্তি তৈরি করার প্রচেষ্টা এবং পুরো দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা।
তিনি জানান, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রতিনিধি এখন কপ-এ 'বৃহৎ সংখ্যায়' অংশ নিচ্ছেন, যাতে ছোট উন্নয়নশীল দেশের কণ্ঠকে 'দমন করা' যায়।
তালিয়া বলেন, 'তারা গল্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তারা প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা সব নথি দুর্বল করার চেষ্টা করে এবং জলবায়ু অর্থায়ন রোধ করতে চায়।'

তিনি আরও বলেন, 'এখন সময় এসেছে বিশ্বের কাছে বলা, আমাদের বাঁচার জন্য অর্থায়ন অত্যন্ত জরুরি।'
তিনি বলেন, 'দূষণকারীকে দায়ভার বহন করতে হবে। যে দূষণ করে, সে দায়ভার বহন করবে।'
তালিয়া আরও জানিয়েছেন, তার নিজের দেশ বাঁচার লড়াই করছে, অথচ অন্য দেশগুলো বর্তমানে এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধের জন্য বিলিয়ন ও ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছে।
তিনি বলেন, 'আপনার দেশ যখন অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে, তখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যুদ্ধ ও সংঘাতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করাটা সত্যিই হতাশাজনক।'
গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)-এর এ সপ্তাহের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৩৯টি ছোট দ্বীপদেশের—যেখানে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন মানুষ বাস করে—আগে থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের সহায়তার প্রয়োজন।
এটি বর্তমানে তারা যে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বছরে পাচ্ছে তার অনেক গুণ বেশি, যা বৈশ্বিক জলবায়ু অর্থায়নের মাত্র ০.২ শতাংশ।
অলাভজনক সংস্থা জিসিএ আরও জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যেই বছরে গড়ে ১.৭ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ।
টুভালু কেবল নিজের বেঁচে থাকার দিকে মনোনিবেশ করছে না, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। বরং তারা বৈশ্বিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
টুভালুর জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী তালিয়া বলেন, 'এই কারণেই টুভালু ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটির নেতৃত্ব দিচ্ছে।'
প্রায় ১৬টি দেশ ইতোমধ্যেই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কলম্বিয়া আগামী বছরে জীবাশ্ম জ্বালানির ধাপে ধাপে নির্মূলের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে।
তালিয়া বলেন, 'আমাদের জন্য এই চুক্তির গুরুত্ব স্পষ্ট। আমরা চাই আরও দেশ যুক্ত হোক, যাতে প্যারিস চুক্তির বাইরে আরও একটি ট্রিটি তৈরি করা যায়।'
'শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়বদ্ধ করতে হবে'
টুভালুর জনসংখ্যা ১০,০০০ এর কম। দেশটি শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের জন্য লড়াই করছে না, একই সঙ্গে তারা নিজের অজানা ভবিষ্যতের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশের সাংস্কৃতিক ধন-সম্পদের ডিজিটাল রেকর্ড তৈরি করা, যাতে কিছুই সমুদ্রে হারিয়ে না যায়।
টুভালুর সংস্কৃতিমন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করছেন মাইনা তালিয়া। তিনি জানিয়েছেন, তিনি জাতিসংঘ সাধারণ সমাবেশের (ইউএনজিএ) দুই সপ্তাহ আগে ইউনেস্কোকে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক আবেদন পাঠিয়েছেন, যাতে 'সম্পূর্ণ টুভালু'কে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, 'যদি আমরা হারিয়া যাই, যা আমরা আশা করি না; তবু অন্তত আমাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষিত থাকবে।'
তালিয়া জানিয়েছেন, টুভালু ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যে সহযোগিতা চুক্তি করেছে, তা দ্বীপটির ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে গেছে এমন কোনো সঠিক নির্দেশনা নয়।
তালিয়া বলেন, 'ফালেপিলি চুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার থেকে পালানোর পথ নয়, বরং একটি সুযোগের পথ।'
চুক্তি অনুযায়ী, টুভালুর মানুষ অস্ট্রেলিয়ায় ভালো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবা পাবে এবং পরে দেশে ফিরে আসবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ বেড়ে গেলেও টুভালুর সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রত্ব বজায় থাকবে এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত অধিকার ও দায়িত্ব রক্ষিত থাকবে।'
তালিয়া আরও জানিয়েছেন, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মোকাবিলায় সহযোগিতা করতে হবে, নির্গমন কমাতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ ও পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে।
তালিয়া বলেন, 'এই রায় পুরো জলবায়ু আলোচনার ধরনই বদলে দিয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত কথা বলেছেন, রায় দিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন আমাদের প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে এটিকে আমাদের জলবায়ু নীতিতে বাস্তবায়ন করব। আমাদের শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়বদ্ধ করতে হবে।'