জলবায়ু ইস্যুতে এক দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে: আন্তর্জাতিক বিচার আদালত

জাতিসংঘের শীর্ষ আদালতের এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে এখন থেকে দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির জন্য মামলা করতে পারবে। খবর বিবিসি'র।
তবে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) এক বিচারক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কোন অংশটি কার কারণে ঘটেছে, তা নির্ধারণ করা জটিল হতে পারে।
রায়টি বাধ্যতামূলক না হলেও এর প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়বে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষ করে যেসব দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য এটি এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পদক্ষেপে অগ্রগতির ঘাটতিতে হতাশ হয়ে এসব দেশ আইনের আশ্রয় নেয়।
২০১৯ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিচু দ্বীপপুঞ্জের কিছু তরুণ আইন শিক্ষার্থীর মাথা থেকে আসে এই নজিরবিহীন মামলার ধারণা। জলবায়ু সংকটের সম্মুখভাগে থাকা জনগোষ্ঠীর হয়ে তারা এই উদ্যোগ নেয়।
তাদেরই একজন, টোঙ্গার সিওসিউয়া ভেইকুনে, আদালতে উপস্থিত থেকে রায় শোনেন। তিনি বলেন, 'আমি বাকরুদ্ধ। এটা অত্যন্ত রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। আমাদের ভেতরে আবেগের ঢেউ চলছে। আমরা গর্বের সঙ্গে এই জয় আমাদের জনগণের কাছে নিয়ে যাব।'
ভানুয়াতুর ফ্লোরা ভানো বলেন, 'আজ রাতে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব। আইসিজে স্বীকৃতি দিয়েছে—আমাদের কষ্ট, আমাদের সহনশীলতা, এবং ভবিষ্যৎ রক্ষার অধিকারকে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই জয় শুধু আমাদের নয়, বরং সারা বিশ্বের সেই সব সম্মুখভাগে থাকা জনগোষ্ঠীর, যারা নিজেদের কথা শোনাতে লড়াই করছে।'

বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে বিবেচিত আইসিজের রায়ের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আইনজীবীরা জানান, এই অভিমত আগামী সপ্তাহ থেকেই বিভিন্ন দেশের আদালতেও ব্যবহৃত হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী উন্নত দেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পথ খুলে যাবে বলে আশা করছেন পরিবেশকর্মী ও জলবায়ু আইনজীবীরা।
দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন-আয়ের বহু দেশ অভিযোগ করে আসছিল যে, উন্নত দেশগুলো তাদের আগের প্রতিশ্রুতি মানছে না। এই মামলায় তাদের সক্রিয় সমর্থন ছিল।
তবে যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি উন্নত দেশ যুক্তি দেয়, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিসহ বিদ্যমান জলবায়ু চুক্তিগুলোই যথেষ্ট, নতুন করে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপের প্রয়োজন নেই।
বুধবার আদালত এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। বিচারক ইওয়াসাওয়া ইউজি বলেন, কোনো দেশ যদি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ না করে, তাহলে তা প্যারিস চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।
তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক আইন এমনকি আরও বিস্তৃত। অর্থাৎ, যারা প্যারিস চুক্তিতে সই করেনি কিংবা ভবিষ্যতে সরে যেতে চায় (যেমন যুক্তরাষ্ট্র), তারাও পরিবেশ ও জলবায়ু রক্ষার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
যদিও আদালতের অভিমতটি পরামর্শমূলক, তবু অতীতে এমন রায় কার্যকর হয়েছে। যেমন, গত বছর যুক্তরাজ্য আইসিজের রায় অনুযায়ী চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের কাছে হস্তান্তর করে।

সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ল'র (সিআইইএল) সিনিয়র অ্যাটর্নি জোয়ে চৌধুরী বলেন, 'এই রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত মোড়।'
তিনি বলেন, 'আইসিজের এই ঐতিহাসিক অভিমতের মাধ্যমে প্রথাগত ধারা ভেঙে স্বীকৃতি দেওয়া হলো—জলবায়ু বিপর্যয়ের শিকার জনগোষ্ঠীর প্রতিকার চাওয়ার অধিকার আছে, যার মধ্যে ক্ষতিপূরণও রয়েছে।'
যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের এক মুখপাত্র জানান, তারা রায়টি পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ছিল, আছে এবং থাকবে যুক্তরাজ্য ও বৈশ্বিকভাবে একটি অগ্রাধিকার। আমাদের অবস্থান হলো—জাতিসংঘের বিদ্যমান চুক্তি ও ব্যবস্থার মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।'
আদালত জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ধ্বংস হওয়া ভবন ও অবকাঠামোর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে। যেসব ক্ষতি পুনর্গঠন সম্ভব নয়, সেখানে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া আদালত বলেছে, কোনো দেশের মধ্যে পরিচালিত কোম্পানিগুলোর জলবায়ু প্রভাবের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকার দায়ী থাকবে। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পে ভর্তুকি প্রদান বা নতুন তেল-গ্যাস প্রকল্প অনুমোদন আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার লঙ্ঘন হতে পারে।
আইসিজের অভিমতকে ভিত্তি করে ইতোমধ্যেই বহু উন্নয়নশীল দেশ অতীতের কার্বন নিঃসরণজনিত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানাচ্ছেন আইনজীবীরা।
তবে কেউ যদি আইসিজেতে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত মামলা করতে চায়, তা কেবল তাদের বিরুদ্ধেই করা যাবে যারা আদালতের এখতিয়ার স্বীকার করেছে। যেমন যুক্তরাজ্য আইসিজের এখতিয়ার মানলেও, যুক্তরাষ্ট্র বা চীন তা মানে না।
তবে সিআইইএলের জোয়ে চৌধুরী জানান, এই অভিমত বিশ্বের যেকোনো আদালতে, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, তুলে ধরা যেতে পারে। তাই কেউ চাইলে আইসিজে নয়, বরং এমন আদালতে মামলা করতে পারে যেখানে সংশ্লিষ্ট দেশ বাধ্য—যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট।
তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—আইসিজের অভিমত কতটা গুরুত্ব পাবে।

ডাউটি স্ট্রিট চেম্বারের জলবায়ু আইনজীবী হার্জ নারুল্লা বলেন, 'আইসিজে একটি প্রতিষ্ঠান, যা ভূ-রাজনীতির প্রভাবের বাইরে নয়। এটির নিজস্ব কোনো বলপ্রয়োগকারী বাহিনী নেই। রাষ্ট্রগুলো স্বেচ্ছায় রায় মানে।'
বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসন সবসময় আমেরিকাকেই অগ্রাধিকার দেয় এবং সাধারণ আমেরিকানদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।'
রায়টি নির্দিষ্ট কোনো চরম আবহাওয়া ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে, যদি প্রমাণ করা যায় সেটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটেছে। তবে বিচারক জানিয়েছেন, এমন প্রতিটি ঘটনার মূল্যায়ন করতে হবে আলাদাভাবে।
ভানুয়াতু ও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অংশ নেওয়া ব্যারিস্টার জেনিফার রবিনসন বলেন, 'এটি জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য বড় এক জয়। ভানুয়াটু এই মামলায় নেতৃত্ব দিয়েছে—এটি বিশ্বজুড়ে জলবায়ু আন্দোলনের রূপ বদলে দেবে।'
তবে কোনো দেশকে কত ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে, সে বিষয়ে এখনো কিছু স্পষ্ট নয়।
নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে—যা দাঁড়ায় ঘণ্টাপ্রতি প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
গত ডিসেম্বরে মামলার শুনানিতে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় বহু দ্বীপবাসী তাদের অভিজ্ঞতা আদালতে তুলে ধরেন।
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তাদের প্রয়োজন ৯ বিলিয়ন ডলার।
জেনিফার রবিনসন বলেন, 'এই ৯ বিলিয়ন ডলার মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য তারা দায়ী নয়, কিন্তু এখন তাদের নিজেদের রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করতে হচ্ছে।'