সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি: বাস্তব শক্তি নাকি শুধুই প্রতীকী
সৌদি আরব ও পাকিস্তান সম্প্রতি একটি কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি (এসডিএমএ) স্বাক্ষর করেছে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ চুক্তির লক্ষ্য দুই দেশের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উন্নত করা এবং যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ শক্তিশালী করা।
চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে, "যেকোনো এক দেশের ওপর আক্রমণ মানেই উভয় দেশের ওপর আক্রমণ।" তবে এখানে কোথাও স্পষ্ট করা হয়নি যে, একে অপরকে সহায়তা করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক হবে কি না। এই ধোঁয়াশা একে অনেকটা ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫-এর মতো করে তুলেছে, যেখানে প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু প্রয়োগের নিশ্চয়তা নেই।
ফলে কিছু পর্যবেক্ষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব সম্প্রতি কাতারে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলের হামলা ঠেকাতে ওয়াশিংটনের অক্ষমতা—বা অনীহা—দেখে আতঙ্কিত হয়েছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটিটি রয়েছে কাতারেই, যার পেছনে দোহা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারও খরচ করে। তবু দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিতে মার্কিনীদের তৎপরতা ছিল অনুপস্থিত।
তাঁদের অভিমত, সৌদি আরব নাকি এখন পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ইসরায়েলকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান অতীতে একাধিকবার আর্থিক সংকটে পড়লে সৌদি আরব তাকে উদ্ধার করেছে।
এর বিপরীতে প্রতিদান হিসেবে ধরা হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সংঘাতে সৌদি আরব পাকিস্তানকে সহায়তা করতে পারে—যেমন দিল্লির কাছে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া, যতক্ষণ না কোনো যুদ্ধবিরতি হয়।
এ যুক্তি আকর্ষণীয় বটে, তবে একই সঙ্গে এটি অনেকটাই প্রতীকী বলেও ধরা হচ্ছে—অর্থাৎ সফট পাওয়ারের জন্য একটি প্রদর্শন মাত্র, যা অনেকের ধারণার মতো বড় কোনো 'গেম চেঞ্জার' নয়।
কারণ, কঠিন বক্তৃতা ছাড়া পাকিস্তান কখনোই ইসরায়েলকে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি দেয়নি। এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে অস্তিত্বগত হুমকি মনে করা সত্ত্বেও, পাকিস্তান কখনো সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে—যদি তেল আবিব সৌদি আরবে বোমা ফেলে— তবুও ইসলামাবাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।
তাছাড়া, পর্দার আড়ালে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সম্পর্ক আসলে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ, ফিলিস্তিন ইস্যুতে মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও। কাতারের মতো সৌদি আরব কিন্তু কোনো ইসরায়েলের-চিহ্নিত কথিত 'সন্ত্রাসী সংগঠনকে' (হামাসকে) আশ্রয়ও দিচ্ছে না।
একইভাবে, সৌদি আরব ও ভারতের সম্পর্ক আরও গভীর। ভারত সৌদি তেলের অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক। শুধু তাই নয়, ভারত, সৌদি আরব ও ইসরায়েল সবাই মিলে ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোর (আইম্যাক)-এর অংশ—যা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লি জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে গাজা যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা রয়েছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা কঠোর বক্তব্য দিলেও, পাকিস্তান যেমন কখনো ইসরায়েলকে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি দেয়নি, সৌদি আরবও একইভাবে কখনোই ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য হুমকি তৈরি করেনি। যদিও সৌদি আরব প্রকাশ্যে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে, তবুও ইসলামাবাদকে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক সহায়তা প্রদান বা দিল্লির বিরুদ্ধে তেল অবরোধের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার ইতিহাস নেই রিয়াদের।
ফলে, এ চুক্তির বাস্তব উদ্দেশ্য সম্ভবত প্রতীকী—কাতারে ইসরায়েলি হামলার পর সৌদি আরবের জন্য 'মুখরক্ষা' এবং মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার গুরুত্ব আবারও স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
এই চুক্তি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পরিস্থিতি হতে পারে, যদি ইয়েমেনের হুথিরা আবার সৌদি আরবের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়। তবে সেটাও সম্ভাব্য তখনই, যদি সৌদি আরব পুনরায় তাদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে এবং তখন পাকিস্তানের সহায়তা চায়।
তবে ২০১৫ সালে সৌদি আরব যখন ইয়েমেন যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানের কাছে জাহাজ, বিমান ও সেনা পাঠানোর অনুরোধ করেছিল, তখন ইসলামাবাদ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই নজির বলে দিচ্ছে, এবারও একই ঘটনা ঘটতে পারে—যদি না যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে।
অন্যদিকে তেল আবিবের পক্ষ থেকে রিয়াদ আক্রান্ত হলে – তাত্ত্বিকভাবে অবশ্য ধরে নেওয়া যায়, পাকিস্তান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সৌদি আরবকে সমর্থন দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে—এমনকি সৌদি আরবে ইসরায়েল বোমা ফেললে ইসলামাবাদ পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের হুমকিও দিতে পারে। একইভাবে সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাতে তেল অবরোধ দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই দুই পরিস্থিতিরই সম্ভাবনা খুবই কম।
তবু অনেক বিশ্লেষক রাজনৈতিক বা আদর্শগত কারণে এ চুক্তিকে বড় কিছু হিসেবে প্রচার করছেন। তাই অনেকে একে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, যদিও প্রকৃত অর্থে এর তেমন কোনো বাস্তব প্রভাব নাও থাকতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।
