‘যমজ টেলিপ্যাথি’ বলতে কি আসলেই কিছু আছে? বিজ্ঞানীরা কী বলছেন

কথা শেষ হওয়ার আগেই একে অপরের বাক্য শেষ করা, হঠাৎ একই ধরনের পোশাকে কোনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া বা একে অপরের ব্যথা অনুভব করার দাবি—এ ধরনের আচরণ প্রায়ই যমজদের মধ্যে দেখা যায়। প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ যমজ জন্মায়, এবং তাদের এই রহস্যময় সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মাঝে কৌতূহল জাগিয়ে আসছে। শুধু চেহারার মিল নয়, তাদের মধ্যে অদ্ভুত ও গভীর বন্ধন মানুষকে মুগ্ধ করে।
'যমজদের সম্পর্কে বহু ধরনের দাবি ও জল্পনা প্রচলিত আছে,' বলেন জোয়ান ব্রোডার, একজন সাইকোলজিস্ট এবং নিজেও যমজ সন্তানদের মা।
যমজদের মধ্যে টেলিপ্যাথি, অর্থাৎ সময় ও স্থান পেরিয়ে একে অপরের সঙ্গে সংযোগের ধারণা সবচেয়ে প্রচলিত ভুল ধারণার মধ্যে একটি। বাস্তব জীবনের গল্পের উদাহরণ থাকলেও, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনও ধরা পড়েনি।
'যদিও এটি প্রকৃত টেলিপ্যাথি নাও হতে পারে, তবু যমজরা একে অপরের আবেগ ও প্রয়োজনের প্রতি যেভাবে সংবেদনশীল, তা সত্যিই চমকপ্রদ,' বলেন টানিয়া জনসন, কানাডার আলবার্টায় ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড সাইকোলজির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সাইকোলজিস্ট।
যমজ টেলিপ্যাথি হলো একধরণের ধারণা যে যমজ, বিশেষ করে একসদৃশ (মোনোজাইগোটিক) যমজরা দূরত্ব অতিক্রম করে একে অপরের অনুভূতি, চিন্তা বা শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করতে পারে; এমনকি পাঁচটি ইন্দ্রিয় ব্যবহার না করেই।
টানিয়া জনসন, কানাডার আলবার্টায় ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড সাইকোলজির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সাইকোলজিস্ট, বলেন, 'যদিও এটি প্রকৃত টেলিপ্যাথি নাও হতে পারে, তবু যমজরা একে অপরের আবেগ ও প্রয়োজনের প্রতি যেভাবে সংবেদনশীল, তা সত্যিই চমকপ্রদ।' তিনি বলেন, এটি এক ধরনের স্বাভাবিক সংবেদন যা এক যমজকে বিপদের সংকেত দিতে পারে, অন্যটির ব্যথা অনুকরণ করতে পারে বা একই মুহূর্তে একই চিন্তা জাগাতে পারে।
বাস্তব জীবনের উদাহরণগুলো কখনও নাটকীয় মনে হতে পারে। যেমন, এক যমজ তার বাহুতে তীব্র ব্যথা অনুভব করে ঠিক তখনই যখন তার যমজ বোন দূরে অন্য দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে ফেলে। আরেকজন হঠাৎ অজানা ভয় অনুভব করে ঠিক সেই মুহূর্তে যখন তার যমজ কোনও দুর্ঘটনার শিকার হন। গবেষকরা এটি প্রায়শই এক্সট্রা-সেন্সরি পারসেপশন (ইএসপি) দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে কোনও ইন্দ্রিয়গত সংকেত ছাড়াই চিন্তা ও অনুভূতি এক যমজ থেকে অন্য যমজের কাছে পৌঁছাতে পারে।
এই ধারণা ১৯ শতকের শেষভাগে জনপ্রিয়তা পায়, যখন আধ্যাত্মিকতা ও প্রাথমিক মনোবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৮৮২ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত 'সোসাইটি ফর সাইকিকাল রিসার্চ' (এসপিআর) ছিল প্রথম কয়েকটি সংস্থার মধ্যে একটি, যারা টেলিপ্যাথি সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ করত, যমজদের ক্ষেত্রেও।
ব্রিটিশ লেখক ও প্যারাপসাইকোলজিস্ট ফ্রেডেরিক ডব্লিউ. এইচ. মায়ার্স—এসপিআর-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য—'টেলিপ্যাথি' শব্দটি প্রবর্তন করেন। তার ১৯০৩ সালের বই হিউম্যান পারসোনালিটি অ্যান্ড ইটস সারভাইভাল অফ বডিলি ডেথ-এ তিনি কয়েকটি যমজ সংক্রান্ত ঘটনা উল্লেখ করেন, যেমন দূরত্বে থাকা যমজরা একে অপরের ব্যথা অনুভব করা বা একই সময়ে একই চিন্তা ভাগাভাগি করা।
পরবর্তী কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রেও অনুরূপ গবেষণা চলতে থাকে। ১৯৩০-এর দশকে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক হোরেশন এইচ. নিউম্যান যমজদের ওপর প্রথম বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণার একজন সহ-লেখক ছিলেন। তিনি পরে টুইন্স অ্যান্ড সুপার-টুইন্স প্রকাশ করেন, যেখানে টেলিপ্যাথি সম্পর্কিত কিছু ঘটনা উল্লেখ ছিল।
প্রায় একই সময়ে, ডিউক ইউনিভার্সিটির প্যারাপসাইকোলজিস্ট জে.বি. এবং লুইসা রাইনও বিস্তৃত ইএসপি গবেষণার সময় যমজদের অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করেন। তবে তাদের পরীক্ষাগুলো মূলত কার্ড অনুমান এবং দূরবীক্ষণের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল, বিশেষভাবে যমজদের জন্য নয়।
তবুও, এই প্রাথমিক আগ্রহের পরও ক্ষেত্রটি কখনো বৈজ্ঞানিকভাবে দৃঢ় ভিত্তি অর্জন করতে পারেনি। 'আমাদের আসল বৈজ্ঞানিক ফলাফলের উপর নির্ভর করতে হয়েছে,' বলেন ন্যানসি সেগাল।
যমজ টেলিপ্যাথি প্রমাণ করা অথবা খণ্ডন করা কখনোই সহজ ছিল না। 'এই বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে খুববেশি গবেষণা নেই," বলেন জোয়ান ব্রোডার।
তবু, কিছু গবেষণা আগ্রহ বজায় রেখেছে। ২০১৩ সালে জার্নাল অফ সায়েন্টেফিক এক্সপ্লোরেশন-এ প্রকাশিত একটি পরীক্ষামূলক গবেষণায় দুইজন যমজের একজনকে হঠাৎ উদ্দীপনা যেমন তীব্র শব্দ বা তাপের সংস্পর্শে আনা হয় এবং অন্যজনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হয়। চার যমজের মধ্যে একটিতে, উদ্দীপিত নয় এমন যমজটি 'সম্ভাবনার চেয়ে বেশি' প্রতিক্রিয়া দেখায়। আগের বছরের একটি ড্যানিশ গবেষণায়ও অনুরূপ ইঙ্গিতপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যায়।
সর্বশেষ, ২০২৪ সালে সুইডেনে প্রকাশিত গবেষণায় একাধিক যমজকে নিয়ে তিনটি পরীক্ষায় ৯১টি উদ্দীপনামূলক ট্রায়াল পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি ট্রায়ালে এক যমজকে উদ্দীপনায় রাখলে অন্যটির ইলেকট্রোডার্মাল কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়। একজন অন্ধ বিচারক ৯১টি ট্রায়ালের মধ্যে ১৮টিতে সঠিকভাবে উদ্দীপনা চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। গবেষকরা টেলিপ্যাথি প্রমাণ করার দাবি না করলেও ফলাফলগুলোকে 'পরিসংখ্যানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ' এবং 'অধিক গবেষণার দাবি রাখে' হিসেবে বর্ণনা করেন।
এসপিআর-এর সমীক্ষা, মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যালোচনা এবং অন্যান্য গবেষণায় যমজদের মধ্যে কিছু মিল দেখা গেলেও কোনো গবেষণা টেলিপ্যাথিক সংযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফলাফলেও পরবর্তী পরীক্ষায় প্রায়শই একই ফল পাওয়া যায় না। 'অনেক গবেষণাতে একটিমাত্র টেলিপ্যাথিক সংযোগও পাওয়া যায়নি,' বলেন টানিয়া জনসন।
ন্যানসি সেগাল বলেন, 'বেশিরভাগ গবেষণায় ইএসপি-এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি, এবং যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল দেখিয়েছে তা পুনরায় যাচাই করা যায়নি। তাই যমজ টেলিপ্যাথি বলে এমন কিছুর কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই।'
তাহলে কেন এত যমজ বিশ্বাস করেন যে তারা টেলিপ্যাথি অনুভব করেছেন? ন্যানসি সেগাল বলেন, 'ইএসপি-এর চেয়েও আরও অনেক বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা আছে।'
প্রথমেই, যমজরা সাধারণত একই পরিবেশে বড় হয়—একই দেখাশোনাকারী, অভিজ্ঞতা, রুটিন, সহপাঠী এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবের মধ্যে। তারা জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং মনোভাবগত প্রবণতাও ভাগাভাগি করে। এসব কারণে, যখন যমজরা মনে করে তারা টেলিপ্যাথি অনুভব করছে, তখন তারা সম্ভবত কেবল 'একটি যোগাযোগের বন্ধন প্রদর্শন করছে, একে অপরের মন পড়ছে না,' বলেন জোয়ান ব্রোডার।
জনসনও এতে একমত। তিনি বলেন, মানুষ যা টেলিপ্যাথি বলে অভিহিত করে, তা প্রায়ই 'যমজদের গভীর আবেগিক বন্ধন এবং ভাগ করা অভিজ্ঞতা' থেকে উদ্ভূত। গবেষণায় দেখা গেছে, একসাথে লালন-পালন করা যমজরা প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে মিল রেখে বিকাশ করে। অন্য কথায়, সেগাল বলেন, 'যদি দুইজনের আবেগ, সামাজিক অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা একই হয়, তারা অনুরূপভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এটি কোনও টেলেপ্যাথি নয়,এটি মনোবিজ্ঞান।'