'চুরি করা শস্য' আমদানির অভিযোগে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞার আহ্বান ইউক্রেনের

দক্ষিণ এশিয়ার এক শীর্ষস্থানীয় ইউক্রেনীয় কূটনীতিক জানিয়েছেন, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে বাংলাদেশি কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অনুরোধ জানাতে যাচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার দখলে থাকা ইউক্রেনীয় অঞ্চল থেকে গম আমদানি করছে। কিয়েভ একাধিকবার ঢাকাকে সতর্ক করলেও তাতে কাজ হয়নি, তাই এখন এই পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে ইউক্রেন।
রুশ বাহিনী ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ কৃষি এলাকা দখল করে রেখেছে।
ইউক্রেন বলছে, ২০২২ সালের আগেই রাশিয়া এসব অঞ্চল থেকে শস্য 'চুরি' করছিল।
তবে রুশ কর্মকর্তাদের দাবি, এসব অঞ্চলের শস্য সংগ্রহকে 'চুরি' বলা যাবে না, কারণ এই অঞ্চলগুলো এখন রাশিয়ার অংশ এবং 'চিরকাল সেভাবেই থাকবে'।
রয়টার্সের হাতে থাকা কিছু নথি অনুযায়ী, নয়াদিল্লিতে ইউক্রেন দূতাবাস চলতি বছর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একাধিক চিঠি পাঠিয়েছে।
এসব চিঠিতে ইউক্রেন দাবি করেছে, রাশিয়ার কাভকাজ বন্দর থেকে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টন 'চুরি করা গম' বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে এবং এসব শস্য গ্রহণ না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এই গোপন কূটনৈতিক যোগাযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভারতে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওলেকজান্ডার পোলিশচুক জানান, বাংলাদেশ এখনও কোনো জবাব দেয়নি।
তিনি বলেন, ইউক্রেনের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, রুশ সংস্থাগুলো দখলকৃত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত শস্য নিজেদের উৎপাদিত গমের সঙ্গে মিশিয়ে তা রপ্তানি করছে, যাতে উৎস গোপন থাকে।
নয়াদিল্লিতে ইউক্রেন দূতাবাসে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পোলিশচুক বলেন, 'এটা একটা অপরাধ।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আমাদের তদন্তের ফলাফল ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশীদারদের কাছে হস্তান্তর করব এবং তাদের কাছে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানাব।'
এ বিষয়ে ইউক্রেন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের খবর আগে প্রকাশিত হয়নি।
বাংলাদেশ বা রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে পাঠানো অনুরোধের জবাব দেয়নি।
বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'যদি গমের উৎস রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চল হয়, তাহলে বাংলাদেশ তার আমদানি নিষিদ্ধ করে থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ কোনো চুরি করা গম আমদানি করে না।'
রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে কৃষি খাত ইউক্রেনের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে রয়েছে। এখনও তারা অন্যান্য দেশে শস্য, উদ্ভিজ্জ তেল ও তৈলবীজ সরবরাহ করে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ইউক্রেন একটি বিদেশি জাহাজ আটক করে, যেটিতে চুরি করা শস্য পরিবহন করা হতো বলে অভিযোগ ছিল।
গত বছরও একই ধরনের অভিযোগে আরেকটি বিদেশি জাহাজ এবং তার ক্যাপ্টেনকে আটক করা হয়।
ইইউ এখন পর্যন্ত রাশিয়ার তথাকথিত 'ছায়া নৌবহরের' অংশ এমন ৩৪২টি জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
ইইউর দাবি, এই নৌবহর রাশিয়াকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তেল, অস্ত্র ও শস্য পরিবহনে সহায়তা করে। রাশিয়া এসব নিষেধাজ্ঞাকে অবৈধ বলেই গণ্য করে।
'এগুলো হীরা বা সোনা নয়'
ইউক্রেনের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ইউক্রেনীয় আইন অনুযায়ী দেশটির কোনো উৎপাদক—বিশেষ করে দখলকৃত অঞ্চলের কৃষকরা—রুশ সংস্থাগুলোর সঙ্গে স্বেচ্ছায় বাণিজ্য করতে পারেন না।
রয়টার্স পর্যালোচনা করা চিঠিগুলোতে দেখা গেছে, নয়াদিল্লির ইউক্রেন দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারকে চারটি চিঠি পাঠিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৪ সাল থেকে দখলকৃত সেভাস্তোপল ও কের্চ বন্দর এবং ২০২২ সাল থেকে মস্কোর দখলে থাকা বার্দিয়ানস্ক বন্দর থেকে রাশিয়ার কাভকাজ বন্দরে শস্য পাঠানো হয়েছে। এরপর সেখান থেকে সেগুলো বাংলাদেশে এসেছে।
চিঠিগুলোতে এসব জাহাজের নাম ও নিবন্ধন নম্বরসহ কাভকাজ বন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর ও সম্ভাব্য আগমনের তারিখও উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চালান পাঠানো হয়েছে ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে।
১১ জুনের চিঠিতে ইউক্রেন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, 'চুরি করা শস্য গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ গুরুতর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারে।'
এতে আরও বলা হয়েছে, এ ধরনের বাণিজ্য 'মানবিক দুর্ভোগ' বাড়ায়।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞা কেবল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নয়, বরং সেইসব সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয় বা সংস্থার নেতাদের ওপরও আরোপিত হতে পারে—যারা জেনে-বুঝে এই কার্যক্রমে সহায়তা করেন বা তা হতে দেন।
রয়টার্সকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ইইউ'র পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক মুখপাত্র আনিত্তা হিপার বলেন, সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলো এখনও কোনো নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েনি।
তিনি বলেন, ইইউ'র নিষেধাজ্ঞা কাঠামো এমন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৈরি করা হয়েছে, যেগুলো ইউক্রেনের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে। 'চুরি করা ইউক্রেনীয় শস্য পরিবহন'ও এর মধ্যে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, যদি কোনো জাহাজের বিরুদ্ধে এসব কাজে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে, তাহলে ভবিষ্যতে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
রয়টার্সের নিজস্ব বিশ্লেষণ বলছে, রাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল (ক্রিমিয়া বাদে) ২০২৪ সালে রাশিয়ার মোট শস্য উৎপাদনের প্রায় ৩ শতাংশের যোগান দিয়েছে।
রুশ শস্য পরিবহনকারী সংস্থা রুসাগ্রোট্রান্সের তথ্য অনুসারে, মে মাসে বাংলাদেশ ছিল রাশিয়ান গমের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রেতা।
রাষ্ট্রদূত পোলিশচুক রয়টার্সকে বলেন, ইউক্রেনের গোয়েন্দা তথ্যে দেখা গেছে রাশিয়া দখলকৃত এলাকা থেকে সংগৃহীত শস্য নিজেদের গমের সঙ্গে মিশিয়ে তা রপ্তানি করছে, যাতে সহজে শনাক্ত করা না যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রুশ শস্য ব্যবসায়ী রয়টার্সকে বলেন, 'রুশ বন্দরে রপ্তানির জন্য শস্য লোড করা হয় যখন, তখন তার সঠিক উৎস শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, 'এগুলো হীরা বা সোনা নয়। বিশ্লেষণ করে এর উৎপত্তিস্থল জানা যায় না।'