২০২১ ঘিরে আমাদের নৈতিক পরিকল্পনা কী?

নতুন বছর ঘিরে কত পরিকল্পনা না করি আমরা। করি কত নতুন শপথ। যেমন; সিংহভাগ মানুষ; বেশি বেশি ব্যয়াম, পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ, অর্থ সাশ্রয়, ওজন কমানো এবং উদ্বেগ মুক্ত থাকব- এমনতর প্রতিজ্ঞা করেন। কেউ কেউ নির্দিষ্ট কোনো পরিচিতের সঙ্গে আরও ভালো আচরণের শপথ করেন। যেমন; স্বামী/স্ত্রী'র সমালোচনা না করা, বৃদ্ধ মাতাপিতা বা আত্মীয়দের খোঁজখবর নেওয়া বা কারো জন্য আরও ভালো বন্ধু হয়ে ওঠা ইত্যাদি।
উন্নত বিশ্বে নতুন বছর ঘিরে নতুন পরিকল্পনা গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া হয়। অথচ খুব মানুষই সব মিলিয়ে একজন আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার অঙ্গীকার করেন। যুক্তরাষ্ট্রে এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমনটাই উঠে আসে। এই আদর্শ বা আরও উত্তম মানুষ হয়ে ওঠা আসলে নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রশ্ন জাগে সকলে কেন নৈতিক উন্নতি নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন। এর একটা ব্যাখ্যা হলো; মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর এবং তাই প্রথমে নিজেরটা নিয়েই ভাবে। নিজের লাভ বা বিলাসব্যসনে বাধা সৃষ্টি করবে এমন বিষয়ে তাই নীতিবান হওয়ার আগ্রহ মানুষ পায় না। আরেকটি উদার ব্যাখ্যায় বলা হয়; কী করা উচিৎ বা কোনটা অনুচিত, সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কিছু স্বকীয় সীমারেখা আর শর্তের অধীনে কিছু মানুষ নৈতিকতা নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, তারা এব্যাপারে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন। হয়তো একারণেই, তা শুধু নতুন বছরের মামলা নয়।
ইহুদি ও খ্রিষ্টীয় ঐতিহ্যের আদলে প্রতিষ্ঠিত সমাজে এমনতর দর্শন আশ্চর্য কোনো ঘটনা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন সমাজের প্রকৃত উদাহরণও বটে, এখানে আজো বাইবেলের মূল দশটি আদেশকে নৈতিকতার কেন্দ্রে রাখা হয়। তবে এটাও ঠিক, আধুনিক জীবনযাত্রায় ঐতিহ্যগত এসব নীতিমালা প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। পুরো পৃথিবীতেই ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে সামাজিক নীতিবোধের দূরত্ব বাড়ছে। সকল ধর্মে সকল স্থানেই একই অবস্থা। কালের চাকায় আধুনিকতার গতিই যেন পাল্টে দিচ্ছে সব। তাইতো মাঝে মাঝে কাউকে হত্যা করার মতো গর্হিত চিন্তাও এখন আমাদের মানস জগতে স্বাভাবিক ঘটনা।
মানসিক জগতের এই যে পরিবর্তন, নীতিবোধের এই যে নতুনতর পরিবর্তন; তার কারণেই কী দরকার না থাকলেও আমাদের মধ্যে চুরি করা একটি লোভনীয় অনুভূতি বা রোমাঞ্চের জন্ম দেয়। আমরা অনেকেই টাকাভর্তি হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগ ফেরত দেই, কিন্তু আমরাই আবার নগণ্য কোনো জিনিষ চুরিতে অসীম আনন্দ পাই (মার্কিনীদের এক অদ্ভুত আচরণ)।
নৈতিকতার ধর্মীয় সংজ্ঞায় বিশ্বাসীরা সৎ জীবনযাপন করতে পারবেন, কিন্তু তাতে শুধু তাদের নিজেদের প্রয়োজন কোনো রকমে মিটবে। পরিবারের চাহিদা পূরণ করাও হবে কঠিন। অর্থাৎ, একজন আদর্শ মানুষের আর্থসামাজিক মূল্যায়ন কম। নৈতিক হওয়ার জন্য তাকে যথেষ্ট সমাদর করা হয় না। সাম্প্রতিক আরেক মার্কিন সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশটির মাত্র ২৩% নাগরিক তাদের জীবনের কোনো না কোনো ব্যাপারে নৈতিক সিদ্ধান্ত ভালো না মন্দ বয়ে আনবে তা নিয়ে চিন্তা করেন।
বেশিরভাগ মানুষ ভাবেন, পরিবর্তনের কী দরকার। বেশতো আছি যেমন আছি (নৈতিকতার ক্ষেত্রে)। তারাও যেমন ভাবেন তেমনি ভাবেন তাদের প্রতিবেশী এবং সহকর্মীরাও। ফলে সামাজিক আদর্শের উন্নতি হয়ে পড়ে বাহ্যিক। অন্তরের উন্নতি সেখানে চর্চিত নয়।
আগের সেই সমীক্ষার বরাতেই দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ মানুষ বিশেষ কিছু সময়ে নৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবেন। এই যে বিশেষ কোনো মুহূর্তে এ চিন্তার উদ্ভব- তার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে নীতি আর দুর্নীতির মাঝের সীমারেখা তারা মাঝেমধ্যেই অতিক্রম করে থাকে। বাকি ৪৬ শতাংশ নীতি সীমা নিয়ে একেবারেই ভাবে না!
সমীক্ষার ভিত্তিতে এভাবেও বলা যায় যে, প্রায় অর্ধেক মার্কিন নাগরিক ন্যায়-নীতির সীমান্ত মানাকে গুরুত্ব দেন না। অথচ ওই একই জরিপে অংশ নেওয়াদের ৮৭ শতাংশ বলেছেন যে, কিন্ডারগার্ডেন থেকে হাইস্কুল পড়ুয়া সকল শিশুকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা সঠিক কথা অবশ্যই। কিন্তু, যারা নিজেরাই জীবনে নীতিসীমা নিয়ে ভাবিত নন, তারা শিশুদের জন্যেই বা কী উদাহরণ সৃষ্ট করছেন?
তাই আমরা দর্শনটি অস্বীকার করছি। আজকের দিনে ভালো মানুষ হয়ে সুস্থ চিন্তা আর কাজ দুইই দরকার। হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের নৈতিকবোধ তৈরি হয়েছে ছোট ছোট সমাজে বসবাসে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। যেসব সমাজে প্রায় সকলেই ছিলেন সকলের পরিচিত। কিন্তু, শিল্পায়ন পরবর্তী যুগের বৃহৎ নগর সভ্যতার যুগে নীতির ওই দর্শন বা সহজাত অনুভূতি অনুপযুক্ত। আজ আমাদের যেকোনো কাজ বা যেকোনো অন্যায়ে বাধা দেওয়ার ব্যর্থতা সারা পৃথিবীর মানুষকে প্রভাবিত করে। আর যারা আগামী শতকেও এখানে বসবাস করবে, তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের আজকের নৈতিক চরিত্রের উপর।
তাই বলা যায়, সব সময় আমরা এখন নৈতিক সিদ্ধান্তের মুখে। জলবায়ু পরিবর্তন, চরম দারিদ্র্যতা বা শিল্পায়িত খামারে হাজার হাজার প্রাণীকে নিষ্ঠুরভাবে খাঁচায় বন্দি রাখা, সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত মৎসারোহন এবং বর্তমান মহামারীর গতিপ্রকৃতি; এসব বৈশ্বিক সমস্যার দিকে এখন সার্বক্ষণিক নজর দেওয়ার সময়। ভোক্তা হিসেবে আর পৃথিবীর দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমরা যেভাবে অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেব, তার উপরই নির্ভর করবে আমাদের গ্রহ ও মানবজাতির অস্তিত্বের ভারসাম্য।
- সূত্র: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
- মূল থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: নূর মাজিদ