আধুনিক সাবমেরিন, কৌশলগত ঘাঁটি: ইরানের নৌবাহিনীর সক্ষমতা কতটুকু?

ইরানের নৌবাহিনী বিশ্বসেরা শক্তিধর নৌবহরগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়। আধুনিক সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজ যুক্ত করে তারা ক্রমেই নিজেদের সামর্থ্য বাড়াচ্ছে। এসব যুদ্ধজাহাজ কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মোতায়েন করে উপসাগরীয় অঞ্চল ও ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব আরও দৃঢ় করছে তেহরান।
সম্প্রতি মার্কিন হামলার পর ইরান কীভাবে জবাব দেবে—সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন তেহরানের দিকে। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—ইরান উপসাগরীয় জলসীমায় মার্কিন স্বার্থকে কতটা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সক্ষম। চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইরানের নৌবাহিনী এখনো ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে সরাসরি কোনো ভূমিকা নেয়নি। এতে প্রশ্ন উঠেছে—তেহরান কি কৌশলগতভাবে তার নৌবাহিনীকে ব্যবহার করছে? আর যদি করেও থাকে, তাহলে বাস্তবে তাদের সামুদ্রিক সক্ষমতা কতটা?
ইরানকে প্রায়ই একটি মহাদেশীয় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরই দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রথম ও শেষ স্তর। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর তেহরান একটি স্তরভিত্তিক নৌ-কাঠামো গড়ে তুলেছে, যা নিয়মিত সেনাবাহিনী ও ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)—এই দুই ভাগে বিভক্ত। এতে বড় যুদ্ধজাহাজের পাশাপাশি ছোট আক্রমণাত্মক বোট, প্রচলিত সাবমেরিন ও ড্রোন সংযুক্ত করে এক যৌথ শক্তি তৈরি করা হয়েছে।
বিশ্বের প্রধান নৌ-শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা না থাকলেও ইরান গড়ে তুলেছে এক ধরনের বিশেষায়িত বাহিনী। যার ভিত্তি হলো অসম যুদ্ধকৌশল, নিজস্ব প্রযুক্তি ও কৌশলগত মোতায়েন। এই শক্তির মাধ্যমে হরমুজ প্রণালী বা ওমান উপসাগরে শত্রুতা মোকাবিলায় ইরানকে একটি স্থায়ী হুমকি হিসেবে ধরা হয়।
নিয়মিত বাহিনী: ইরানের নৌবহর—অতীত ও বর্তমান
ইরানের নিয়মিত নৌবাহিনী (আইআরআইএন) সাবমেরিন ও বড় যুদ্ধজাহাজসহ সম্পূর্ণ নৌবহরের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। এ বাহিনীতে রয়েছে ১৮ হাজার ৫০০-এর বেশি সদস্য এবং ১০০টিরও বেশি জাহাজ ও সাবমেরিন। পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে তারা সক্রিয়ভাবে অভিযান চালায়। এ বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের আঞ্চলিক জলসীমা রক্ষা, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নৌপথ নিরাপদ রাখা এবং সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের যেকোনো চেষ্টা প্রতিহত করা।
'গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার'-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪৫টি নৌবাহিনীর মধ্যে ইরানের অবস্থান ৩৭তম। এই অবস্থান হয়তো ইরানকে বিশ্ব পরাশক্তিদের কাতারে ফেলবে না, কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ইরানের নৌ-সক্ষমতা যে বেড়েছে, তা স্পষ্ট। এই র্যাংকিং ইঙ্গিত দেয়, ইরানের নৌবাহিনী এখন একটি মধ্যম মাত্রার শক্তি, যা নিজ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম।
ইরানের নৌবহরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর বৈচিত্র্য। এখানে রয়েছে—
- 'জুলফিকার', 'সাহান্দ' ও 'জাগরোস'-এর মতো আধুনিক ডেস্ট্রয়ার, যা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও গোয়েন্দা অভিযানের উপযোগী।
- 'আলফান্ড' ও 'মোজ' শ্রেণির ফ্রিগেট—কিছু ব্রিটিশ নির্মিত, কিছু ইরানে তৈরি—যা মাঝারি মাত্রার নৌ অভিযানে ব্যবহৃত হয়।
- অ্যামফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ ও করভেট, যা দ্রুত হামলা ও সেনা পরিবহনে কাজে লাগে।
তবে বহরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো সাবমেরিন। ইরানের হাতে রয়েছে ১৯ থেকে ২৭টি সাবমেরিন। এর মধ্যে তিনটি 'তারিক' শ্রেণির (কিলো-শ্রেণির) ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিন, যা কৌশলগত অভিযানে ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি রয়েছে দুটি 'ফাতেহ' শ্রেণির সাবমেরিন ও প্রায় ২৩টি 'গাদির' শ্রেণির ক্ষুদ্র সাবমেরিন, যেগুলো অগভীর পানিতে দক্ষতার সঙ্গে চলতে পারে।

সাবমেরিন: পানির নিচের নীরব অস্ত্র
তেহরানের এখনো পারমাণবিক চালিত কোনো সাবমেরিন নেই, তবে তারা দীর্ঘদিন ধরেই এ প্রযুক্তি অর্জনের চেষ্টা করছে। ২০১৮ সালে ইরানি কর্মকর্তারা পারমাণবিক সাবমেরিন নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানায়। তবে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সেই পথে বাধা হয়ে আছে।
তবে ইরানের ডুবোজাহাজ বহরে কিছু উন্নত সাবমেরিন রয়েছে, যেমন—
- তারিক শ্রেণি: রুশ নির্মিত ৭৪ মিটার দীর্ঘ সাবমেরিন, যা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া ও মাইন বসাতে সক্ষম।
- ফাতেহ শ্রেণি: স্থানীয়ভাবে নির্মিত, ২০১৯ সালে যুক্ত হয়। এতে টর্পেডো ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ব্যবস্থা রয়েছে।
- গাদির শ্রেণি: ছোট আকৃতির প্রায় ২৩টি সাবমেরিন, যা বিশেষ অভিযান ও হঠাৎ হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়।
- নাহাঙ্গ শ্রেণি: একটি মাত্র সাবমেরিন রয়েছে, যার কাজ হলো বিশেষ বাহিনী পরিবহন।
এই সাবমেরিনগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ইরান 'এয়ার-ইন্ডিপেনডেন্ট প্রোপালশন' (এআইপি) প্রযুক্তি সংযোজনের চেষ্টা করছে, যা পানির নিচে দীর্ঘসময় অবস্থানের সুযোগ দেবে।

কৌশলগত নৌ ঘাঁটি: ইরানের নৌবাহিনীর মোতায়েন কেন্দ্র
ইরানের নৌ ঘাঁটিগুলো ক্যাস্পিয়ান সাগরের উত্তরে এবং পারস্য ও ওমান উপসাগরের দক্ষিণে বিস্তৃত। প্রতিটি ঘাঁটির নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
- বন্দর আব্বাস: সবচেয়ে বড় ঘাঁটি, নৌবাহিনীর প্রধান দপ্তর এবং জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র।
- জাস্ক: ওমান উপসাগরের প্রবেশমুখে প্রতিরক্ষার প্রথম স্তর হিসেবে কাজ করে।
- চাবাহার: ভারত মহাসাগরের একমাত্র মুখোমুখি ইরানি ঘাঁটি, মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার।
- বন্দর-ই আনজালি: উত্তরের ঘাঁটি, সাবমেরিন নির্মাণ ও তেল স্থাপনার নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- খার্গ: পারস্য উপসাগরে, তেল স্থাপনাগুলোর জন্য সেনা মোতায়েন করা হয়।
- ইমাম আলি: চাবাহারে অবস্থিত, গোয়েন্দা ও আক্রমণাত্মক টহলে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া, আইআরজিসি-র নির্দিষ্ট ঘাঁটি রয়েছে হরমুজ প্রণালীর কাছে সিরিক, আবু মুসা, তাম্ব আল-সুঘরা ও তাম্ব আল-কুবরা দ্বীপে। আবু মুসা দ্বীপে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ভূগর্ভস্থ দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে।

বিপ্লবী গার্ড নৌবহর: অসম যুদ্ধকৌশলেই শক্তি
ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর নৌবাহিনী (আইআরজিসিএন) পরিচালিত হয় এক বিশেষ কৌশলে—'অসম যুদ্ধকৌশল'। এতে রয়েছে দ্রুতগতির ক্ষেপণাস্ত্রবাহী বোট, সমুদ্রে মাইন নিক্ষেপ, এবং হঠাৎ আঘাত হেনে সরে যাওয়া।
এই বাহিনীতে রয়েছে—
- ১০টি হুদং বোট
- ২৫টি পেইকাপ-টু বোট
- ১০টি এমকে-১৩ বোট
- গোপন তথ্য সংগ্রহ ও আক্রমণের জন্য বিশেষ ইউনিট
এই বাহিনীর হাতে বড় জাহাজ না থাকলেও তাদের গতি ও কৌশলগত দক্ষতাই মূল শক্তি, যা শত্রুর জন্য স্থায়ী হুমকি তৈরি করে।
আধুনিক সরঞ্জাম ও সক্ষমতা বৃদ্ধির অগ্রগতি
২০২৪ সালের আগস্টে ইরানের নৌবাহিনী ২ হাজার ৬৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর মধ্যে রাডারে ধরা না পড়া ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। একই সময়ে এক ক্ষুদ্রাকৃতির সাবমেরিন থেকে সফলভাবে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ পরীক্ষাও চালানো হয়, যা তাদের আক্রমণাত্মক সক্ষমতা বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়।
এর আগে ২০২৩ সালে ইরানি নৌবাহিনীর একটি বহর প্রায় আট মাসব্যাপী এক দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা সম্পন্ন করে। তারা ৬৩ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্রথমবারের মতো ম্যাজেলান প্রণালিতে পৌঁছায়। বহরটিতে ছিল ডানা ডেস্ট্রয়ার ও সহায়ক জাহাজ মাকরান—যা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইরানের উপস্থিতি বৃদ্ধির স্পষ্ট বার্তা দেয়।