'স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় এটি কাজ করে না': অস্কারের নিয়ম পরিবর্তনের আহ্বান জাফর পানাহির

জাফর পানাহি, বিশ্বের হাতে গোনা কয়েকজন পরিচালকের মধ্যে একজন, যিনি ভেনিস গোল্ডেন লায়ন, বার্লিন গোল্ডেন বিয়ার এবং কান পাম ডি'অর—এই তিনটি সম্মাননা জিতে অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছেন ঠিকই, তবুও কখনও অস্কারের দৌড়ে অংশ নিতে পারেননি।
এর কারণ হলো, ইরান এই ভিন্নমতাবলম্বী পরিচালকের কোনো ছবিকে কখনও অস্কারের জন্য মনোনীত করেনি। পানাহিকে দীর্ঘকাল ধরে ইরানে চলচ্চিত্র নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। যদিও তিনি গোপনে ছবি নির্মাণ চালিয়ে গেছেন এবং এর জন্যে দুবার কারাবরণও করেছেন। এই নিষেধাজ্ঞাই তার চলচ্চিত্রগুলোকে অস্কারের আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছাতে দেয়নি।
তবে, সম্প্রতি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম ডি'অর জেতা তার নতুন চলচ্চিত্র 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট'-এর মাধ্যমে এই পরিস্থিতি পাল্টাতে চলেছে। ছবিটির মার্কিন পরিবেশক নিওন এবং ফরাসি প্রযোজক ফিলিপ মার্টিন এখন পানাহিকে অস্কারের মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
প্রাথমিকভাবে, তারা ফ্রান্সকে এই ছবিটি সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার চলচ্চিত্রের জন্য তাদের প্রতিযোগী হিসেবে জমা দিতে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন।
এদিকে, টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের পর পানাহি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা পেয়েছেন। সামনে তিনি টেলুরাইড এবং নিউইয়র্ক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেবেন। টেলুরাইড, টরন্টো এবং বুসান উৎসবে তাকে 'এশিয়ান ফিল্মমেকার অব দ্য ইয়ার' হিসেবে সম্মানিত করা হবে।
সাবেক রাজনৈতিক বন্দিদের একটি দলকে নিয়ে এই ছবির গল্প, যারা একজন ব্যক্তিকে অপহরণ করে। আগামী ১৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে ছবিটি মুক্তি পেতে চলছে।
মার্টিনের তথ্য অনুযায়ী, ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র সংস্থা সিএনসি ছবিটি অস্কারের জন্য দেশের বাছাই করা সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অনুমোদন দিয়েছে। এই তালিকা থেকেই দেশটি তাদের চূড়ান্ত প্রতিযোগী নির্বাচন করবে।
মার্টিন বলেন, 'পানাহিকে সম্মান জানানোর জন্য এটি ফ্রান্সের জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ।' তিনি উল্লেখ করেন যে, পানাহি একমাত্র জীবিত পরিচালক যিনি কান, ভেনিস এবং বার্লিন থেকে শীর্ষ পুরস্কার জিতেছেন।
দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা ও সরকারের বাধার পর এটি জাফর পানাহির জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি আক্ষেপ করে ২০০৬ সালের তার ছবি 'অফসাইড'-এর ঘটনা স্মরণ করে বলেন, 'চলচ্চিত্রটি ইরানে প্রদর্শনের অনুমতির জন্য ইরানি কর্মকর্তাদের কাছে একটি চিঠি লেখা হয়েছিল। কারণ অ্যাকাডেমির নিয়ম অনুযায়ী অস্কার প্রতিযোগীদের চলচ্চিত্র অবশ্যই নিজ দেশে মুক্তি পেতে হয়। কিন্তু সরকার তাতে অস্বীকৃতি জানায়।'
তার কোনো ছবিই এর আগে বা পরে ইরানে প্রদর্শিত হয়নি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'এগুলো (অস্কার জেতার) এমন সুযোগ যা সরকার ক্রমাগত ইরানি সিনেমা থেকে কেড়ে নিয়েছে। শুধু আমার ছবি নয়, আমার বন্ধুদের ছবিও, যারা কখনও অস্কারের সুযোগ পাননি।'
ফ্রান্স বা লুক্সেমবার্গ 'ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট'-কে তাদের অস্কার প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে পানাহি বলেন, 'আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা যে, আমার সব ছবি, প্রথমবারের মতো, ইরানে প্রদর্শিত হোক।'
এরপর তিনি অ্যাকাডেমির নিয়মাবলী নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, মূল সমস্যাটি অ্যাকাডেমির নিয়মের মধ্যেই নিহিত। তিনি বুঝতে পারেন না যে কখন তারা এই নিয়মগুলো পরিবর্তন করবে, যেখানে সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে।
পানাহি বলেন, 'অ্যাকাডেমিই একমাত্র সাংস্কৃতিক সত্তা যা বিশ্বের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তাদের সরকারের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে।' যখন চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের ছবি উৎসবে পাঠান, তখন তাদের কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয় না। তার মতে, অ্যাকাডেমির নিয়মগুলো গণতান্ত্রিক সরকারগুলির জন্য কার্যকর হলেও, স্বৈরাচারী শাসনগুলির জন্য নয়। পানাহি মনে করেন, অস্কারে প্রতিযোগিতা করতে হলে তাকে এমন একটি ছবি বানাতে হবে যা সরকারের রুচি ও শৈলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, তবেই তারা সেটি ইরানে প্রদর্শন করতে দেবে।
জাফর পানাহি অস্কারে 'স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা'দের জন্য অলিম্পিকের স্বাধীন অ্যাথলেটদের মতো একটি পৃথক বিভাগ চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করেন, এটি কার্যকর হলে বিশ্বজুড়ে সেন্সরশিপের চাপে থাকা নির্মাতারা উপকৃত হবেন এবং সরকার-নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র তৈরির সুযোগ পাবেন।
পানাহি বলেন, তার 'ইট ওয়াজ নট অ্যান অ্যাকসিডেন্ট' ছবিটি যদি অন্তত একটি বা একাধিক অস্কার জেতে, তবে তা শুধু তার জন্য নয়, বরং অনেক স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্য এক বড় অনুপ্রেরণা হবে, যারা সরকারি নিষেধাজ্ঞার ভয় ছাড়াই কাজ করতে চান। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন উৎসবে অনেক স্বাধীন ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে।
পানাহি আরও জানান যে, বর্তমানে একদল চলচ্চিত্র নির্মাতা অ্যাকাডেমির কাছে একটি চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। চিঠিতে তারা বলছেন যে, বর্তমান নিয়মগুলো কার্যকর নয় এবং একটি নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তার মতে, নতুন একটি বিভাগ তৈরি হলে তা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাজ চালিয়ে যেতে এবং তাদের আশা যোগাতে খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ঠিক যেমন অন্যান্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ইভেন্টগুলো করে থাকে। তিনি আশা করেন, এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাতারা সরকারি সীমাবদ্ধতার উদ্বেগ ছাড়াই স্বাধীন চলচ্চিত্র তৈরি করতে সক্ষম হবেন।