তিতাস একটি নদীর নাম: আরেকবার

১
সারা ভারতের অনেক অপেক্ষাকৃত অনালোচিত পরিচালকদের মধ্যে সম্ভবত ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) সবচেয়ে মেধাবী। যদিও মাত্র অল্প কটা ছবি বানিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে প্রথমটি নাগরিক ১৯৫২ সালে সম্পূর্ণ; এই ছবিটি ক্রমাগত মদ্যপান আর যক্ষায় মাত্র একান্ন বছরে তাঁর অসময়োচিত প্রয়াণের পরও মুক্তি পায়নি। ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাদ্রাজ চলচ্চিত্র উৎসবে পাশ্চাত্য চিত্রসমালোচকদের তাঁর একগুচ্ছ কাজ দেখবার সুযোগ হলো প্রথমবারের মতো। প্রিন্টগুলো ছিল জীর্ণ আর পুরোনো সাবটাইটেল পড়া যাচ্ছিল না, প্রজেকশনের মান এমনকি ভারতীয় মানদণ্ডেও ছিল অনেক নিচের দিকে।
কিন্তু উপস্থিত সকলের ওপর ছবিগুলোর অভিঘাত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। এখানে, সবাই বুঝতে পারছিলেন, আবেগপ্রবণ এবং প্রবলভাবে জাতীয় একজন চিত্রনির্মাতা অন্যদের কাজের সাথে তেমন সংযোগ ছাড়াই আত্মপথ অনুসন্ধান করতে পেরেছেন; এবং নিশ্চিতভাবে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের।
তাঁর মৃত্যুর দুই বছরের মধ্যেই তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন; একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে যিনি নিজেকে ধ্বস্ত করেছেন, কিন্তু তাঁর কাজের জীবন রহস্যময় অশুভ প্রভাবে আক্রান্ত ছিল আবেগপ্রবণ শরণার্থী হিসেবে ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপরম্পরার মাধ্যমে এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তাঁর মেধা শনাক্তকরণে ব্যর্থতার দরুন।

ডেরেক ম্যালকম ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের মুখপত্র সাইট অ্যান্ড সাউন্ড পত্রিকায় ১৯৮২ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যায় ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে যে গদ্য লেখেন, তার শুরুটি ছিল এমন। দেশভাগের ফলে আমরা আমাদের ভূখণ্ডের অনেক মানুষরতন হারাই, যাদের মধ্যে সবচেয়ে মহার্ঘ্য ঋত্বিক। চলচ্চিত্র মাধ্যমে একমাত্র তিনিই শরণার্থী বিপন্নতা নিজের স্নায়ুতন্ত্রীতে অনুভব করেছিলেন। আকাশপথে বাংলাদেশে আসার সময় তাঁর সর্বস্ব নিংড়ানো কান্নার ইতিহাস সবারই জানা। তাই অবিস্মরণীয় কথাসাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম' অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব পেলে দ্বিতীয়বার না ভেবে গ্রহণ করেন।
২
'তিতাস একটি নদীর নাম 'চলচ্চিত্রটি তন্নিষ্ঠ মনোযোগে দেখবার পর কোনো কোনো অনুভবী দর্শক যদি ঋত্বিক-কন্যা সংহিতা ঘটকের 'ঋত্বিক এক নদীর নাম' গ্রন্থের প্রথম কিছু পৃষ্ঠা পড়েন, তিনি বুঝতে পারবেন অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাহিনির কাঠামোতে নিজের ছেলেবেলার পূর্ববঙ্গীয় স্মৃতিকেই উদ্যাপন করছেন নদীর মহাকাব্য প্রণেতা ঋত্বিক ঘটক, অশ্রুজলে। দূরে জলের আভাস, অর্ধচন্দ্রাকৃতি মরুভূমিপ্রতিম এক দৃশ্যে যে চলচ্চিত্রে প্রবেশ ঘটে আমাদের, তার প্রসঙ্গে দু-একটা কথা বলার আগে অন্য আলাপে যাই। ছোট আলাপ।

আলা বাদিউ চলচ্চিত্র সম্পর্কে যে প্রায় ত্রিশটি গদ্য রচনা করেছিলেন, সে সংকলনের শুরু হয় এক নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। তাতে তিনি বলেন, 'চলচ্চিত্র হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বের শনাক্তিচিহ্ন।' কথাটা অন্যভাবে বলা যায়, মানব অভিজ্ঞতার ইতিহাসকে নথিভুক্ত করবার আধুনিক পদ্ধতি হলো দৃশ্য পরম্পরার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিনেমা। আরেকজন মানুষের কথা বলি। তিনি রবার্ট ম্যাকফার্লেন। ব্রিটিশ সাহিত্য সমালোচক। প্রচুর ঘুরে বেড়ান, ভাষা আর প্রকৃতি তাঁর কাজের ক্ষেত্র। এই মে মাসেই প্রকাশিত সাম্প্রতিক বই 'ইজ আ রিভার এলাইভ?', এতে তিনি নদীকে জীবন্ত অস্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি না, এই বিষয়ে নানাভাবে সওয়াল জবাব করেছেন।

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে নিজেদের সংবিধানে প্রকৃতির অধিকারকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দেশ ইকুয়েডর। ওহাঙ্গানুং নদীকে 'আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক সত্তা' হিসেবে সংরক্ষণ করবার এক আইন পাস হয় ২০১৭ সালে, নিউজিল্যান্ডে। ভারতে বিচারকেরা গঙ্গা ও যমুনা নদীকে স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবন্ত অস্তিত্ব হিসেবে। ২০২১ সালে ঘটে আরও চমকপ্রদ ঘটনা। ম্যাগপাই নদী 'আইনসম্মত ব্যক্তি এবং জীবন্ত সত্তা'র প্রথম নদী হিসেবে ঘোষিত হয়। যুক্তরাজ্যেও পূর্ব সাসেক্সের লুইস কাউন্সিল ওউসে নদীর সব ধরনের অধিকার নথিভুক্ত করেন। কোনো নদী জ্যান্ত কি না, এই প্রশ্ন আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশ তো বটেই, উপমহাদেশেই একটা বাহুল্য প্রশ্ন মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে প্রশ্নটির প্রাসঙ্গিকতা উত্তরোত্তর বেড়ে যাচ্ছে। নদীশাসন আর নদীদূষণ কত শত নদীকে অর্ধমৃত করে রেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। আমরা অ্যালা বাদিউ আর রবার্ট ম্যাকফার্লেনের কথা দুটি মনে রেখে চলচ্চিত্রের আলাপে ফিরি।

৩
খই ঝরে পড়ে–বাসন্তী, সুবল আর কিশোরের ছেলেবেলায়। আনন্দের চিত্রমালায় একধরনের শোক প্রস্তাবের শুরুয়াৎ। দর্শকের স্মরণের অন্তর্গত শোক মিছিলে ঝরে পড়ছে উড়ন্ত খই। তিতাসে নদী মরে, মানুষ মরে। কেউ শোকগ্রস্ত জীবন টানতে টানতে জলতৃষায়, কেউ বিবেকের প্রহারে নিজেকে নিকেশ করে, কেউ বিস্মৃতি থেকে স্মৃতির আলো-আঁধারি মনোজগতে ঘুরতে ঘুরতে। উপরিকাঠামোয় একটি অপহরণ প্রচেষ্টা অন্তত তিনটি মানবসন্তানের গতিপথ বদলে দেয়। কেন তীব্র প্রেমে পাটাতন খুলে খুলে কিশোর দেখতে যাচ্ছিল নব পরিণীতাকে! নিয়তিনির্দেশ ব্যতিরেকে আর কী।
রাজার ঝি, কিশোর আর অনন্ত। সুবলের অকালপ্রয়াণ আর নাছোড় মাতৃহৃদয় বাসন্তীর ঋজু অস্তিত্বকে বারবার খাদের কিনারে নিয়ে যায়। এখনকার সমাজেও সিঙ্গেল মাদারদের পরিস্থিতি কহতব্য নয়। দ্বিতীয় মহাসমরের আগে ও পরে তিতাসের দুই পারজুড়ে এই মানুষেরা যখন বেঁচে থাকবার লড়াই করছিলেন, তখনকার পরিস্থিতি সহজেই অনুমেয়। দুজন নারীÑবাসন্তী আর রাজার ঝি, একটিই সন্তান চিরদুরন্ত অনন্ত। নামের মতোই অনন্ত একদিন কালের মহাকল্লোলে মিশে যাবে। তার আগে দুজন নারীর হৃদয়ে বাৎসল্যের আশ্রয় হয়ে রইবে।

কিশোর আর রাজার ঝি–শিব আর পার্বতীর নব রূপায়ণ ঘটিয়ে প্রয়াত হলেন নদীর পারেই। অনন্ত সর্বহারা হলো। সর্বস্বহারা হতে কিছু বাকি ছিল, কেননা বাসন্তী। কেননা তখনো স্বপ্নে মা ভগবতী রূপে আসেন নিজের একান্ত আপনার মা। কিন্তু ওই চড়, প্রবল ক্রোধের অথচ সাময়িক উত্তেজনার, আজকালকার ভাষায় 'হিট অব দ্য মোমেন্ট' চড়, বাসন্তীর চড় যা নেমে আসে নিয়তির মতো এবং আসার পর অনন্ত অনন্তের দিকে ছুটে যায় পিছুটান ফেলে।
কে যেন বলেছিলেন, এভরি টাচ হ্যাজ আ মেমোরি। শ্বাসের বিচ্ছুরণ চলচ্চিত্রের পর্দাজুড়ে বিস্তারিত হয় এবং কিশোর জলসভ্যতার প্রবল আগ্রাসী তরঙ্গবহুল পুরুষের প্রতিনিধি। কিন্তু আলো-আঁধারি। কেউ কাউকে দেখে না। দোল স্নানে এক জোরালো টানে, অতি আদরে কোলে নেয়ার পর বিন্দু মুহূর্তের জন্য স্মৃতি ফিরেছিল কি না কিশোরের, আমরা জানি না। স্রষ্টা ঋত্বিক জানান না। আর তখন বিবশ রাজার ঝি চোখ বন্ধ করে রাখে যেন এমন আদর মূলত অন্য পারে যাওয়ার পারানি মাত্র।

প্রযোজক হাবিবুর রহমান খানের এক বক্তব্যে আমরা পাই, ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই এই চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু হয়। সিনেমাটা মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই। তখন তাঁর বয়স ২৫-২৬ বছর। মুক্তিযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। তাঁরা অনেকেই অস্ত্র জমা দেননি। না জমা দেওয়া অস্ত্র কাজে লেগেছিল, এই সিনেমার প্রয়োজনে নানা সরকারি সম্পত্তি ব্যবহার করার সময়। দ্রুত কার্যসিদ্ধির জন্য ধমকচমক চির কার্যকর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুটিংয়ে বৃষ্টির জন্য ফায়ার সার্ভিসের মেশিন ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লে এসব ধমকের কাজে ব্যবহার করেছিলেন প্রযোজক। এক রাতে একটি স্পিডবোট এবং ঋত্বিক ঘটক দুজনই গায়েব। দেখা গেল, যে এলাকায় শুটিং তার উল্টো দিকে, আরিচার উল্টো দিকে তিনি পাবনা শহর খুঁজতে গিয়েছিলেন। গ্রামে দীর্ঘ সময় ছেলেবেলার দিন অতিবাহিত হওয়ার অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকে খুঁড়ে এনে চিত্রায়িত করেছেন ঋত্বিক। মাঘমণ্ডলের ব্রত থেকে শুরু করে পিঠেপুলির লোকায়ত, দোলের আবির খেলা–চলচ্চিত্রের শরীর অলংকৃত অসংখ্য লোকগানের অকুণ্ঠিত ব্যবহারে। লীলাবালি গানের আরেক বিখ্যাত চিত্রপ্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। উদ্দেশ্যের জায়গা থেকে আকাশপাতাল ফারাক। আহমেদের ক্ষেত্রে পুঁজির দাসত্ব আর চটুল বিনোদন বিহনে কিছুই ছিল না।

৪
জল ফুরিয়ে যায় একদিন। শেষ চুমুকের জলও লভ্য হয় না। চর জাগে। ঋত্বিক জলকেন্দ্রিক সভ্যতাকে সম্প্রসারিত করেন শস্য উৎপাদন সম্ভাবনার কল্পনায়। চরের জমিতে প্রাণঘাতী যুদ্ধের চিত্রায়ণে কারও মনে পড়তে পারে মহান চিত্রকর সুলতানের পেশিবহুল কৃষকদের। সুলতান আর ঋত্বিক বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্র। গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছের রূপকল্প অন্তত কল্পনির্মাণেও ফেরে। মাছ যার জীবিকা, কৃষিকাজে ব্যাপৃত কেমন করে হবেন তিনি! তবু বাসন্তীর কাদাজলে চুমুক দেওয়ার ব্যর্থতার পরেও, মরণের সন্নিকটস্থ অতি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও মনের চোখে দেখে এক দুরন্ত শিশু ভেঁপু বাজিয়ে ছুটে যায়। এই দেখাটুকুন ঋত্বিকের অমর আশাবাদ অথবা বাসন্তীর অতৃপ্ত মায়ের হৃদয়ের কল্পনাÑতা নির্ণয়ের স্পর্ধা মানুষের নেই।

পুনশ্চ: একটি ছোট তথ্য যুক্ত করি। অনুষ্টুপ প্রকাশিত, সুরমা ঘটক লিখিত 'পদ্মা থেকে তিতাস' (দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ ২০১০) গ্রন্থের ৬৫ পৃষ্ঠায় 'তিতাস একটি নদীর নাম' চলচ্চিত্রের নৌকাবাইচের দৃশ্য আয়োজন করবার নেপথ্য ঘটনা আছে। দৃশ্য ধারণ হয় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। পুরো ঘটনাটি ঘটিয়ে তোলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এই বইতে ভুলবশত 'সুরজিৎ সেনগুপ্ত' মুদ্রিত হয়েছে। সুরঞ্জিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
গোকর্ণঘাট, এলাকার আঞ্চলিক লোকমুখে এখন 'গোপনঘাট', অনুজপ্রতিম বন্ধু বিজয় দেবনাথের ঐকান্তিক প্রয়াসে এই সময়ের অঞ্চলটির কয়েকটি নির্বাচিত আলোকচিত্র যুক্ত করে দিলাম। আমার ধারণা, খারাপ লাগবে না।
ঋণ: সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজীব আহসান