আগাথার একই উপন্যাস থেকে শোয়ার্জনেগার ও স্ট্যালনের অ্যাকশন সিনেমা—দুটোই ফ্লপ

আগাথা ক্রিস্টির বিখ্যাত রহস্য উপন্যাস 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান' নতুনভাবে উঠে আসে দুই অ্যাকশন সুপারস্টার আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার ও সিলভেস্টার স্ট্যালনের চলচ্চিত্রে। অথচ বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আগাথা ক্রিস্টি অন্যতম জনপ্রিয় রহস্য ও থ্রিলার লেখক। তার লেখা রহস্য উপন্যাস 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান' সময় পেরিয়ে আজও— পাঠকের মনে জায়গা করে আছে।
মূল গল্প বেশ সহজ, অচেনা কিছু মানুষ এক দূরবর্তী দ্বীপে আসে। এরপর একে একে সবাই খুন হতে থাকে। কে খুন করছে, কেন করছে— এই রহস্যই গল্পে পাঠককে ডুবিয়ে রাখে। এই অনন্য গল্প পরে বহু বই, সিনেমা ও টিভি শো-তে ফিরে ফিরে এসেছে।
এই উপন্যাসের প্রভাব পাওয়া যায় 'বডিজ বডিজ বডিজ', ২০০৩ সালের 'আইডেন্টিটি' এবং প্রথম 'ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ' সিনেমাতেও। সাহিত্যনির্ভর ছবির তালিকায় সিলভেস্টার স্ট্যালন বা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের নাম খুব একটা দেখা যায় না। তবে এই দুই অ্যাকশন তারকাই নিজেদের মতো করে আগাথা ক্রিস্টির বিখ্যাত খুনের গল্পকে পর্দায় তুলে ধরেছেন।
শোয়ার্জনেগারের স্যাবোটাজ ছবিটি হলো এক ভয়াল গল্প, যেখানে একে একে খুন হচ্ছেন চরিত্ররা। অন্যদিকে, ডি-টক্স সিনেমাটি স্ট্যালনের একমাত্র হরর চলচ্চিত্র, যেখানে তিনিই কেন্দ্রীয় চরিত্রে।
১৯৯৯ সালে ডি-টক্স ছবির শুটিং শেষ হলেও এটি মুক্তি পায় তিন বছর পর। মুক্তির পর দর্শক ও সমালোচকদের মাঝে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। প্রায় ৫৫ মিলিয়ন বাজেটের ছবিটি আয় করে মাত্র ৬ মিলিয়নের কিছু বেশি।
তবে ব্যর্থ হলেও, ছবির কিছু দিক প্রশংসনীয়। স্ট্যালনের অভিনয় ছিল ভিন্নধর্মী। এক অপরাধবোধে ভোগা, মদ্যপ এফবিআই কর্মকর্তার চরিত্রে তাকে মনে হয়েছে, খানিকটা দুর্বল ও আবেগপ্রবণ। সহ-অভিনয়ে ছিলেন জেফরি রাইট, রবার্ট প্যাট্রিক ও স্টিফেন ল্যাং-এর মতো শক্তিশালী অভিনয়শিল্পীরা।
ডি-টক্স ছবিতে কিছু জমজমাট দৃশ্যও রয়েছে। গল্পে দেখা যায়, আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের একটি দুর্গম ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, সেখানে হঠাৎ এক ধারাবাহিক খুনি বা সিরিয়াল কিলার হামলা চালাতে থাকে, যার লক্ষ্য শুধু পুলিশ সদস্যরা।
একজন একজন করে খুন হতে থাকলে, স্ট্যালনের চরিত্র 'ম্যালয়' ধীরে ধীরে নেতৃত্বের ভূমিকা নেয় এবং বুঝতে পারে, খুনি আসলে এই দলেই লুকিয়ে আছে। ছবিটি যেন একদিকে 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান', অন্যদিকে 'দ্য থিং'-এই দুটি গল্পের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে স্ট্যালনের চেনা অ্যাকশনধর্মী চরিত্রের ছাপ।
ডি-টক্স ছবির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো রহস্য বা উত্তেজনার অভাব। খুনের দৃশ্যগুলোতে নেই তেমন সৃজনশীলতা; আর খুনিকে যখন প্রকাশ করা হয়, তখন দর্শকের প্রতিক্রিয়া হয়— 'লোকটা জানি কে?'
ছবির আবহও বেশ মলিন। রঙের ব্যবহার নেই বললেই চলে, যা একধরনের বিষণ্নতা তৈরি করে পুরোটা জুড়ে।
তবু যারা স্ট্যালনের ভক্ত, তাদের জন্য এটি দেখার মতো। কারণ, এই ছবিতে তিনি একেবারে ভিন্নধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ছবিটি মুক্তি পায় স্ট্যালনের ক্যারিয়ারের এক কঠিন সময়ে, যখন একের পর এক ছবিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি নতুন ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের চেষ্টা করছিলেন।
বলাই বাহুল্য, 'ডি-টক্স' অ্যাগাথা ক্রিস্টির 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান'–এর খুব একটা সফল রূপান্তর নয়।
এই ছবির পর স্ট্যালন কিছু চরিত্রনির্ভর ছবিতে অভিনয় করেন, যেমন 'গেট কার্টার'–এর রিমেক ও 'শেড'। কিন্তু সেগুলোও 'ডি-টক্স'–এর মতোই ব্যর্থ হয়েছিল। তবু বলতে হয়, স্ট্যালনের এই ছবি আর শোয়ার্জনেগারের 'স্যাবোটাজ'–এর তুলনায় কিছুটা হলেও আলাদা ও আগ্রহোদ্দীপক ছিল।
পর্দায় নতুনভাবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টায় ব্যর্থ হন আর্নল্ড
ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হিসেবে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর ২০১৩ সালে আবারও বড় পর্দায় ফেরেন আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার। তিনি এমন তিনটি ছবি বেছে নেন, যেখানে ছিল চিরচেনা অ্যাকশন আর থ্রিল, তবে সেগুলো তার বয়সের চাহিদা অনুযায়ী মানানসই ।
দুঃখজনকভাবে, তার আধুনিক ওয়েস্টার্ন ঘরানার ছবি 'দ্য লাস্ট স্ট্যান্ড' বা 'এস্কেপ প্ল্যান' কোনোটিই তেমন সাফল্য পায়নি। আর 'স্যাবোটাজ' ছিল সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। ডেভিড এয়ার পরিচালিত এই থ্রিলার মূলত 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান' এমন এক গল্প যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ-ডিইএ এর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা একে একে খুন হতে থাকেন এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে।
ডি-টক্স–এর মতোই, স্যাবোটাজ–এরও রয়েছে বিখ্যাত সব অভিনয়শিল্পী, আর শুরুতে মনে হয় গল্পটি বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু কিছুটা আগালেই দেখা যায়, ছবিটি নানা কারণে ব্যর্থ। আর্নল্ডের চরিত্র 'ব্রিচার' এবং তার টিম একদমই পছন্দ করার মতো নয়, উল্টো বিরক্তিকর। এমনকি তারা যেভাবে একে একে নির্মমভাবে খুন হয়, সেটাও দর্শকের জন্য আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে না।
পরিচালক ডেভিড এয়ার চেয়েছিলেন, আর্নল্ডের পর্দার পরিচিত ইমেজ ভেঙে দিতে। তাই তাকে দেখানো হয় এক কঠোর, আত্মকেন্দ্রিক নেতার ভূমিকায়। সে নিজেই দলের সদস্যদের ডেকে এনেছে বিপদে, কারণ সে তাদের দিয়ে মাদকচক্রের টাকা চুরি করিয়েছিল।
২০১২ সালে পরিচালক ডেভিড এয়ার বলেছিলেন, স্যাবোটাজ–এ তিনি আর্নল্ডকে নতুনভাবে তুলে ধরবেন। তবে আর্নল্ড সেই চরিত্র পুরোপুরি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। ছবির প্রথম গল্পের শেষাংশে ব্রিচারকে খুনি হিসেবে দেখানোর পরিকল্পনা ছিল, যা দর্শক সমালোচনার কারণে পরবর্তীতে পরিবর্তন করা হয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিতে গিয়ে— ছবিটা সাদামাটা অ্যাকশন থ্রিলারে পরিণত হয়।
৩৫ মিলিয়ন বাজেটের ছবিটি বিশ্বজুড়ে মাত্র ২২ মিলিয়ন আয় করেছিল এবং মুখোমুখি হয়েছিল কঠোর সমালোচনার। সাবোটাজ ছিল আর্নল্ডের শেষ মূল চরিত্র হিসেবে অভিনয়, এরপর থেকে তিনি পার্শ্বচরিত্রেই অভিনয় করেছেন।
স্ট্যালনের একমাত্র হরর সিনেমা 'ডি-টক্স' দর্শকের মন ছুঁতে পারেনি
স্ট্যালন একবার যখন অ্যাকশন ঘরানায় জায়গা করে নেন, এমন গল্প বাদে তিনি খুব কমই কাজ করতেন । যদিও 'কোবরা'–চলচ্চিত্রে কিছুটা ভৌতিক ও রহস্যময় খুনের গল্প ছিল, এবং 'র্যাম্বো ৫' কিছুটা পশুপাখি ঘিরে তৈরি থ্রিলার গল্প। তবে তার হরর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা প্রায় নেই।
'ডি-টক্স' তার এক্ষেত্রে একমাত্র বড় চেষ্টা, যা মূলত 'অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান'–এর উপর ভিত্তি করে তৈরির কারণে মনযোগ পেয়েছিল। স্ট্যালনই ছবির মূল আকর্ষণ, কিন্তু একইসঙ্গে সমস্যা। তাকে এধরনের ছবিতে দেখতে অস্বাভাবিক লাগে। এতে রক্তক্ষয়ী দৃশ্য খুব কম, আর খুনির পরিচয় রহস্যময় করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টাও নেই।
শেষে স্ট্যালনের চরিত্র আর খুনির মধ্যে হওয়া হাতাহাতি—হঠাৎ করেই অতিরিক্ত অ্যাকশন যোগ করার প্রয়াস মনে হয়।
ডি-টক্স একদিকে হরর ভক্তদের জন্য যথেষ্ট ভয়ঙ্কর নয়। অন্যদিকে থ্রিলার প্রেমীদের জন্য যথেষ্ট রহস্যও এতে নেই। তবে দুর্দান্ত তারকাদের অভিনয় দেখার মজা আছে। নতুন কিছু করার চেষ্টা হিসেবে এটিকে মনে রাখা যেতে পারে। ছবির ব্যর্থতা স্ট্যালনের ক্যারিয়ারে এক ধাক্কা ছিল। তবে ২০০৬ সালে 'রকি বালবোয়া' চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি ফের আলোচনায় আসেন।
মূল লেখার ভাবানুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা