সামরিক প্রযুক্তি উন্নয়নে বিপুল ব্যয় চীনের; ভারত-পাকিস্তান সংঘাত প্রথম বড় পরীক্ষা

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান সংঘাত বিশ্বকে প্রথমবারের মতো দেখার সুযোগ করে দিচ্ছে—পরীক্ষিত পশ্চিমা সরঞ্জামের বিরুদ্ধে চীনের উন্নত সামরিক প্রযুক্তি কেমন কাজ করবে।
এরই মধ্যে চীনের প্রতিরক্ষা খাতের শেয়ারদর দ্রুত বাড়ছে। চীনা কোম্পানি এভিআইসি চেংডু এয়ারক্রাফট-এর শেয়ার এই সপ্তাহে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। কারণ পাকিস্তান দাবি করেছে, বুধবার তারা চীনের তৈরি জে-১০সি ফাইটার জেট ব্যবহার করে ভারতের যুদ্ধবিমান—যার মধ্যে ফ্রান্সের তৈরি অত্যাধুনিক রাফালও রয়েছে—ভূপাতিত করেছে।
তবে ভারত এখনও পাকিস্তানের এই দাবির বিষয়ে বা কোনো বিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি।
চীনের তৈরি জেট ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, 'তিনি এই বিষয়ে অবগত নন।'
তবে পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসেবে তার অস্ত্র ও প্রযুক্তিগুলো বাস্তব যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতে কীভাবে কাজ করতে পারে, তা চীন সম্ভবত খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
একটি উদীয়মান সামরিক পরাশক্তি হিসেবে চীন গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনো বড় যুদ্ধের সম্মুখীন হয়নি। তবে নেতা শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে দেশটি তার সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে—উন্নত অস্ত্র ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তৈরিতে প্রচুর সম্পদ ব্যয় করছে।
এই আধুনিকায়ন কার্যক্রম চীন তার ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানেও সম্প্রসারিত করেছে, যাকে বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে 'লৌহপ্রতীম বন্ধুত্ব'-এর মর্যাদা দিয়ে আসছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে পাকিস্তানের আমদানি করা অস্ত্রের ৮১% সরবরাহ করেছে চীন।
এই অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে উন্নত ফাইটার জেট, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—যেগুলো যে কোনো ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কিছু পাকিস্তানি অস্ত্র আবার চীনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি হয়েছে বা চীনের প্রযুক্তি ও দক্ষতা ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাংক এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিচালক সাজ্জান গোহেল বলেন, 'এর মানে হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো সংঘর্ষ প্রকৃতপক্ষে চীনের রপ্তানি করা সমরাস্ত্রের জন্য একটি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।'
চীন ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্রমবর্ধমান অত্যাধুনিক যৌথ আকাশ, সমুদ্র ও স্থল মহড়ায় চালায়। যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ সিমুলেশন এবং এমনকি ক্রু-সোয়াপিং ড্রিলও।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের সিনিয়র ফেলো ক্রেইগ সিংগেলটন বলেন, 'চীন অনেক দিন ধরেই পাকিস্তানকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, আর এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়তা দিচ্ছে—যার ফলে ধীরে ধীরে যুদ্ধের কৌশলগত ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'এটি আর শুধু একটি দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষ নয়; চীনের রপ্তানি করা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে আঞ্চলিক প্রতিরোধকে নতুন রূপ দিচ্ছে এটি তারই একটি দৃষ্টান্ত।
কাশ্মীরে পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনার ফলে এই পরিবর্তনটি এখন স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে। এটি একটি বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসকে তুলে ধরে, যেখানে চীন এখন মার্কিন প্রভাবের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর কাশ্মীর ইস্যুতে তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। স্নায়ু যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থন করেছিল, আর যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। পরমাণু শক্তিধর দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাতকে ঘিরে এখন মহাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন যুগের সূচনা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী হলেও, ভারত ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। একের পর এক মার্কিন প্রশাসন দক্ষিণ এশিয়ার এই উদীয়মান শক্তিকে চীনকে মোকাবিলায় একটি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায়, ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো—যেমন ফ্রান্স ও ইসরায়েল—থেকে অস্ত্র কেনা বাড়িয়েছে এবং একসঙ্গে রাশিয়ার ওপর অস্ত্র নির্ভরতা ধীরে ধীরে কমিয়ে এনেছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছে এবং ক্রমান্বয়ে দেশটির 'যেকোনো পরিস্থিতির বিশ্বস্ত কৌশলগত সহযোগী' এবং প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বৈশ্বিক পরিকাঠামো প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠেছে।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই)- তথ্য অনুযায়ী, ২০০০-এর দশকের শেষ দিকে পাকিস্তানের অস্ত্র আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা বন্ধ করে দিয়েছে এবং ধীরে ধীরে চীনা অস্ত্র দিয়ে তার অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে।
এসআইপিআরআই -এর অস্ত্র স্থানান্তর কর্মসূচির সিনিয়র গবেষক সাইমন ওয়েজম্যান বলেছেন, 'যদিও ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই চীন পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ ছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের শূণ্যস্থান পূরণের মাধ্যমেই এই খাতে চীনের আধিপত্য তৈরি হয়েছে।'
এক দশকেরও বেশি আগে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল যে, পাকিস্তান তালেবানসহ অন্যান্য 'সন্ত্রাসী'দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
ওয়েজম্যান বলেন, এটি ইসলামাবাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং গণতন্ত্রের অভাব নিয়ে ওয়াশিংটনের বিদ্যমান হতাশাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
তিনি বলেন, '(যুক্তরাষ্ট্র) অবশেষে এ অঞ্চলে ভারতকে বিকল্প অংশীদার হিসেবে খুঁজে পেয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এর ফলস্বরূপ, পাকিস্তানকে প্রায় পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।'
তিনি বলেন, 'অন্যদিকে পাকিস্তানে চীনের অস্ত্র সরবরাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায় – বলা চলে চীন এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের একমাত্র প্রকৃত বন্ধু এবং মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।'
পাকিস্তানে ভারতীয় সামরিক হামলায় দুঃখ প্রকাশ করেছে চীন এবং তারা শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানিয়েছে।
সর্বশেষ উত্তেজনার আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক ফোনালাপে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের 'লৌহপ্রতীম বন্ধুত্ব' বলে অভিহিত করেছেন।'

সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
যেহেতু পাকিস্তান প্রধানত চীন থেকে এবং ভারত তার অস্ত্রের অর্ধেকের বেশি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো থেকে সংগ্রহ করে, তাই এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যেকোনো সংঘাত কার্যত চীনা এবং পশ্চিমা সামরিক প্রযুক্তির মধ্যে একটি শোডাউন হতে পারে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ ভারতীয় পর্যটকের নিহতের জেরে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বৈরি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরপর বুধবার ভোরে পাকিস্তানে মিসাইল হামলা চালায় ভারত।
নয়াদিল্লির দাবি, তারা পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে 'সন্ত্রাসী অবকাঠামো' লক্ষ্য করে আক্রমণ করেছে।
অনেক বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন যে, ভারতের কাছে থাকা ফ্রান্সে তৈরি রাফাল এবং রাশিয়ায় তৈরি সু-৩০ যুদ্ধবিমানগুলো থেকে মিসাইল এবং অন্যান্য গোলাবারুদ ছোঁড়া হয়েছে।
এদিকে, পাকিস্তান দাবি করেছে যে তাদের জে-১০সি যুদ্ধবিমান ১৬০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লায় এক ঘণ্টার লড়াইয়ে ১২৫টি বিমান ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে তিনটি রাফাল, একটি মিগ-২৯ এবং একটি এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমানও ছিল বলে দাবি করে তারা।
ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক গবেষক সালমান আলী বেত্তানি বলেন, 'এটি বর্তমানে পরমাণু শক্তিধর দুটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র আকাশযুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।'
তিনি বলেন, এই সংঘাত চীনা আধুনিক সমরাস্ত্রের কার্যকর ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
তবে ভারত তার কোনো বিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি এবং পাকিস্তান এখনও তার দাবির সমর্থনে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেনি।
তবে একটি ফরাসি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, নিজেদের সবচেয়ে নতুন এবং অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলোর মধ্যে একটি—ফ্রান্সে তৈরি একটি রাফাল যুদ্ধবিমান—যুদ্ধে হারিয়েছে ভারত।
টরন্টোভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষণা প্রতিষ্ঠান কোয়া গ্রুপ ইনকর্পোরেটেড -এর প্রতিষ্ঠাতা বিলাল খান বলেন, 'যদি ... এ তথ্য সত্য হয়, তাহলে এটা বোঝা যায় যে পাকিস্তানের হাতে থাকা সমরাস্ত্রগুলো অন্ততপক্ষে পশ্চিম ইউরোপ (বিশেষ করে ফ্রান্স) যা সরবরাহ করে তার সমতুল্য বা সমসাময়িক।'
আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তা বা পাকাপোক্ত প্রমাণ না থাকলেও, চীনা জাতীয়তাবাদী এবং সামরিক সরঞ্জামপ্রেমীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনাকে চীনা অস্ত্র ব্যবস্থার অন্যতম বিজয় হিসেবে অভিহিত করছেন।
পাকিস্তানের জে-১০সি যুদ্ধবিমান নির্মাতা চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এভিআইসি চেংডু এয়ারক্রাফট- এর শেয়ারের দাম বুধবার শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জে ১৭ শতাংশ বেড়েছে।
এমনকি তখনও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিমানগুলো দিয়ে ভারতের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবিই তোলেননি। বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার আরও ২০ শতাংশ বেড়ে যায়।
জি-১০সি হলো চীনের এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট বহুমুখী যুদ্ধবিমান জে-১০-এর সর্বশেষ সংস্করণ, যা ২০০০-এর দশকের শুরুতে চীনা বিমানবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
উন্নত অস্ত্র ব্যবস্থা ও অ্যাভিওনিক্স (যন্ত্রাবলী) সমন্বিত এই বিমানটিকে ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়—যার অবস্থান রাফালের সমান স্তরে। তবে চীনের জে-২০ বা যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫-এর মতো ৫ম প্রজন্মের স্টিলথ যুদ্ধবিমানের থেকে এর অবস্থান একধাপ নিচে।
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভি-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে চীন পাকিস্তানে জে-১০সিই–এর প্রথম চালান সরবরাহ করে।
পাকিস্তান ও চীনের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ৪.৫ প্রজন্মের হালকা ওজনের যুদ্ধবিমান জেএফ-১৭ ব্লক-থ্রি'র পাশাপাশি এটি এখন পাকিস্তানের অস্ত্রাগারের সবচেয়ে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান।
পাকিস্তান বিমান বাহিনী (পিএএফ) আমেরিকায় নির্মিত এফ-১৬ এর একটি বড় বহরও ব্যবহার করে, যার মধ্যে একটি ২০১৯ সালের উত্তেজনার সময় সোভিয়েত-ডিজাইন করা ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
বিশ্লেষক খান বলেন, পাকিস্তানের এফ-১৬ গুলোর কনফিগারেশন এখনও ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে সীমাবদ্ধ রয়েছে, যা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র যেসব উন্নত সংস্করণ সরবরাহ করে তার থেকে অনেক পিছিয়ে।
অন্যদিকে, চীনা নির্মিত জে-১০সিই ও জেএফ-১৭ ব্লক থ্রি-তে অ্যাক্টিভ ইলেকট্রনিক্যালি স্ক্যানড অ্যারে (এইএসএ)- রাডারের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে।
তিনি বলেন, 'তাই এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলো এখনও পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র, তবে তা আর প্রধান বা অপরিহার্য নয়।'
বেইজিংয়ের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও কৌশল কেন্দ্রের সিনিয়র ফেলো সিনিয়র কর্নেল (অব.) ঝোউ বো বলেন, যদি চীনে তৈরি জে-১০সি-এর মাধ্যমে সত্যিই ফ্রান্সে তৈরি রাফাল ভূপাতিত করা হয়ে থাকে, তাহলে তা চীনা অস্ত্রব্যবস্থার প্রতি আস্থা বৃদ্ধির জন্য একটি অসাধারণ সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।'
ঝোউ আরও বলেন, এটি 'নিশ্চয়ই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, বিশেষ করে যেহেতু চীন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনো যুদ্ধ করেনি।।'
তিনি আরও বলেন, 'এটি আন্তর্জাতিক বাজারে চীনা অস্ত্র বিক্রির জন্য সম্ভবত একটি বড় অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।'

'একটি শক্তিশালী বিজ্ঞাপন'
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানির ৪৩ শতাংশই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। যা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ফ্রান্সের শেয়ারের চারগুণেরও বেশি, এরপরই রয়েছে রাশিয়া।
চীন চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, তাদের অস্ত্র রফতানির দুই-তৃতীয়াংশই যায় একটি দেশে, সেটি হলো পাকিস্তান।
টরন্টোর প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক খান একমত হয়েছেন যে, যদি এই ভূপাতিত করার [চীনের জে-১০সি ফাইটার জেট ব্যবহার করে ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমান] বিষয়টি নিশ্চিত হয়, তাহলে এটি চীনের প্রতিরক্ষা শিল্পকে প্রচারের জন্য অনেক সহায়ক হবে।
তিনি বলেন, এর মাধ্যমে 'মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার শক্তিগুলোর' আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে, যারা সাধারণত 'সর্বাধুনিক পশ্চিমা প্রযুক্তি'র নাগাল পায় না।
তিনি আরও বলেন, 'ইউক্রেনে আক্রমণের কারণে রাশিয়া পিছিয়ে পড়ায়, আমি নিশ্চিত চীন এখন মস্কোর দখলে থাকা বাজারগুলো—যেমন আলজেরিয়া, মিশর, ইরাক ও সুদান—লক্ষ্য করে জোরালোভাবে বড় অঙ্কের অস্ত্র বিক্রির চেষ্টা চালাচ্ছে।'
পাকিস্তান ও চীনের বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত জে-১০সি যুদ্ধবিমানগুলো সম্ভবত চীনের সবচেয়ে উন্নত এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পিএল-১৫ এর সঙ্গে যুক্ত। এই ক্ষেপণাস্ত্র দৃশ্যসীমার বাইরে ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার (১২০–১৯০ মাইল) পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে বলে জানা গেছে। তবে এর রপ্তানি সংস্করণে পাল্লা কমিয়ে ১৪৫ কিলোমিটার (৯০ মাইল) রাখা হয়েছে।
গত সপ্তাহে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তান বিমান বাহিনী তাদের যুদ্ধবিমানের তিন মিনিটের একটি ভিডিও প্রকাশ করে। ওই ভিডিওতে পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত জেএফ-১৭ ব্লক থ্রি যুদ্ধবিমান দেখানো হয় এবং একে 'পাকিস্তান বিমান বাহিনীর শক্তিশালী হাতিয়ার' বলে অভিহিত করা হয়।
ম্যাকাও-ভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক অ্যান্টনি ওং দোং পাকিস্তানের দাবির প্রসঙ্গে বলেন, 'চীনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এক প্রকার শক্তিশালী বিজ্ঞাপন।'
তিনি আরও বলেন, 'এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও এতে চমকে যাবে—ভাববে তার প্রতিপক্ষ আসলে কতটা শক্তিশালী? এটি এমন এক প্রশ্ন যা যেসব দেশ যুদ্ধবিমান কিনতে আগ্রহী তাদের এবং চীনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে—এই নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি তারা কীভাবে হবে তা তাদের ভাবতেই হবে?'
তবে কিছু বিশেষজ্ঞ সতর্কতা প্রকাশ করেছেন।
তারা বলেন, ভারতের যুদ্ধবিমান হারানোর বিষয়টি যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটা হয়তো চীনা অস্ত্রের উন্নত প্রযুক্তির কারণে নয়, বরং ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুর্বল কৌশল ও পরিকল্পনার ফল হতে পারে।
ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস-এর বিশ্লেষক সিংলেটন বলেন, 'যদি ভারতের একাধিক যুদ্ধবিমান হারানোর খবর সত্য হয়, তাহলে এটা শুধু যুদ্ধবিমানের মান নয়, বরং ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রস্তুতির ওপরই বড় প্রশ্ন তুলবে।'
তিনি আরও বলেন, 'রাফাল যুদ্ধবিমানগুলো আধুনিক ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধজয়ের মূল বিষয় হলো সমন্বয়, পরিকল্পনা আর টিকে থাকার দক্ষতা — শুধু দামি যুদ্ধবিমান কিনে ফেললেই হবে না।'
ভারতের কাছে পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কে কী ধরনের গোয়েন্দা তথ্য ছিল, তাও স্পষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ- যদি ভারতের ধারণা থাকত যে পাকিস্তানের কাছে কেবল স্বল্প-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র আছে, তাহলে ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলো হয়তো দুর্বল জায়গাগুলোতে আরও বেশি সময় অবস্থান করত।
অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরক্ষা নীতি বিষয়ক গবেষক ফ্যাবিয়ান হফম্যানের মতে, রুলস অব এনগেজমেন্টের কারণে হয়তো ভারতীয় পাইলটরা প্রথমে গুলি চালাতে বা পাকিস্তানি বিমানের ওপর পাল্টা গুলি চালাতে পারেননি।
হফম্যান তার মিসাইল ম্যাটার্স ব্লগে লিখেছেন, এসব ক্ষেত্রে ভারতের ভুল সিদ্ধান্তই হয়তো পাকিস্তানি অস্ত্রশস্ত্রকে আরও কার্যকর করে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও উল্লেখ করেছেন, ভারতের হামলা সফলভাবে পাকিস্তানের একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে এর ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পাকিস্তানের বিমান প্রতিরক্ষা ভেদ করেছে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় চীনের তৈরি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এইচকিউ-৯বি দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ব্যবহৃত হয়েছিল।
লন্ডনের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ গোহেল বলেন, 'যদি চীনা রাডার বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ভারতীয় হামলা শনাক্ত বা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা বেইজিংয়ের অস্ত্র রপ্তানি নির্ভরযোগ্যতার জন্যও খারাপ সংকেত।