যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭% শুল্ক তিন মাস স্থগিত রাখার অনুরোধ করবে সরকার

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে চিঠি দেবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের মধ্যে একক দেশ হিসেবে বৃহত্তম, এই রপ্তানিকে পাল্টা শুল্কারোপের আঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখতেই করা হবে এ অনুরোধ।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি থেকে আমদানি বাড়াতে শুল্কছাড় দেওয়া, মার্কিন তুলার জন্য কেন্দ্রীয় ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু করা, সরকার সঙ্গে সরকারের মধ্যে চুক্তির (জি-টু-জি) ভিত্তিতে এলএনজিসহ জ্বালানি আমদানি বাড়ানো এবং অশুল্ক বাধা দূর করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
একই উদ্দেশ্যে আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর- ইউএসটিআরকে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ইউএসটিআরকে পাঠানো চিঠির খসড়া ইতোমধ্যে তৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আজ সকালে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর জন ফে'র নেতৃত্বে দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে চিঠি চূড়ান্ত করে সোমবার সন্ধ্যার মধ্যেই তা ইউএসটিআরকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই সভায় যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপিত নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার বা অশুল্ক বাধাগুলো দূর করার উপায় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। ইউএসটিআরে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এদিনই প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষরিত চিঠিটিও পাঠানো হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে।
এসব চিঠিতে সময়ানুবর্তী একটি সাহসী অ্যাকশন প্ল্যান থাকবে— মার্কিন পণ্যের আমদানি বাড়াতে শুল্কহার কমানো নিয়ে, যা ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ৩ মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে ঢাকা।
এর আগে (শনিবার) প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'বাণিজ্য ঘাটতি' কমানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও- গতকাল সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাংলাদেশের পাঠানো চিঠিতে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর অঙ্গীকার করা হবে না। বরং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। কারণ, নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের ফলে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়লেও— যদি বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ তার চেয়ে বাড়ে, তাহলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে না। তাই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গতকাল রোববার ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সঙ্গে সভা ছাড়াও— বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারগুলো তুলে নেওয়ার অঙ্গীকারসহ বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার অঙ্গীকার থাকবে ওইসব চিঠিতে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরপর বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা গতকাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। যার অংশ হিসেবে, রোববার সকালে বাংলাদেশে ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, শিল্প উপদেষ্টা মো. আদিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান ও আন্তর্জাতিক-বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।
এই বৈঠকের পরে অংশীজনদের নিয়ে এক সভা করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সভা শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো যাতে ঠিকাদারি কাজে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়, সেজন্য পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকেও জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সঙ্গে বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে— তা তুলে ধরেন উপদেষ্টারা। একইসঙ্গে বাংলাদেশে বিদ্যমান ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারগুলোর মধ্যে যেগুলো যুক্তরাষ্ট্র সমস্যা মনে করছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক ইস্যুগুলো দ্রুতই সমাধান করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত যেসব বিষয় বাংলাদেশের জন্য সহায়ক নয়, সেসব বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, "আমাদের ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, সেগুলো বুঝার চেষ্টা করেছি। তার মধ্যে যেগুলো আমাদের অর্থনীতির জন্য সহায়ক, সেগুলো তো আমরা করতেই চাই। আর যেগুলো সহায়ক নয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে উপায় বের করা হবে।"
এদিকে ইউএসটিআরকে পাঠাতে ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিঠির খসড়া তৈরি করেছে বলে গতকাল এ সংক্রান্ত এক সভায় জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মো. মাহবুবুর রহমান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে শুল্ক ছাড় দেওয়া, দুই সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন তুলার জন্য কেন্দ্রীয় ওয়্যারহাউজ চালু করা, এবং শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো কমিয়ে দেশটি থেকে আমদানি বাড়াতে অ্যাকশন প্ল্যান তুলে ধরা হচ্ছে চিঠিতে।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করতে দ্রুত টিকফার বৈঠক আয়োজন করতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের তৎপরতা সম্পর্কেও যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হবে।
কেন্দ্রীয় ওয়্যারহাউজ চালু হলে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানিকারকরা তুলা এনে বাংলাদেশে ওয়্যারহাউজে মজুদ করে রাখতে পারবেন। বাংলাদেশের স্পিনাররা এই তুলা আমদানির এলসি খুললে পরদিনই ওয়্যারহাউজ থেকে মিলগুলোকে তুলা সরবরাহ করা হবে। এতে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানি সহজেই ৩-৪ গুণ বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এই ওয়্যারহাউজ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বর্ধিত ট্যারিফ ঘোষণার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত— আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ইউএসটিআরকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে 'উইন উইন সিচুয়েশন' নিশ্চিত করতে ইউএসটিআর এর সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে আলোচনায় সম্পৃক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনিসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এদিন বিকেলে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, খলিলুর রহমান, লুৎফে সিদ্দিকী এবং বেজা'র এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরসহ সরকারের শীর্ষ নীতি-নির্ধারক ও বেসরকারিখাতের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে – উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। এজন্য রপ্তানিকারকদের পদক্ষেপে সরকার সহায়তা দেবে।
এছাড়া, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বৃহৎ অর্থনীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কহারের প্রেক্ষাপটে কী পদক্ষেপ নেয় এবং তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে জানান তিনি।
@কী বলছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা:
অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীরা তাদের মতামত জানিয়েছেন। সভা শেষে এ প্রসঙ্গে বিটিএমএর সাবেক সভাপতি তপন চৌধুরী বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতি ঘোষণার পর যতটা চিন্তিত ছিলাম, সরকারের তৎপরতা দেখে এখন আর সেই দুশ্চিন্তা নেই। সরকার একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে, যেখানে ব্যবসায়ীদের জন্য সুখবর থাকছে।"
দেশের শীর্ষস্থানীয় জুতা রপ্তানিকারক অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, সরকার একটি টাইমবাউন্ড পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে একটি স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা সময়মতো বাস্তবায়ন হলে— চ্যালেঞ্জ উৎরানো সহজ হবে, বরং কিছু সম্ভাবনাও দেখা দেবে।
তিনি বলেন, "যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবৃদ্ধিশীল বাজার। এজন্য মাথায় রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা যেন না হারাই। একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও কী কী আমদানি করা যায়— সেটা বিবেচনা করতে হবে।"
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, "আমরা আশা করছি বাংলাদেশ থেকে এরকম একটি চিঠি যাবে, যেটি ডোনাল্ড ট্রাম্প পড়তে বাধ্য হবেন।"
বিজিএমইএ'র আরেক সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো চিঠিতে সরকার চিঠিতে তিন মাস সময় চাইবে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা যাতে বাংলাদেশে সহজে ব্যবসা করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে সরকার।
বিকেএমইএ'র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম জানান, "কেন্দ্রীয় ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু হলে তুলা আমদানি ৩-৪ গুণ বাড়বে। ফলে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বাড়বে।"
তিনি বলেন, "এখন যেসব তৈরি পোশাক সরবরাহ পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোতে আগের প্রাইস ট্যাগ লাগানো হয়েছে। ৯ এপ্রিল নতুন শুল্কহার কার্যকর হলে বায়াররা ওই চালান গ্রহণ না করে ফেরত পাঠাবে। তাই বাংলাদেশের অনুরোধে তিন মাসের মধ্যে বাড়তি ট্যারিফ কার্যকর না করলে— এই চালানগুলো রপ্তানি করা সম্ভব হবে।"
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ, এমএ রাজ্জাক, এবং এফবিসিসিআই এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান রোববার সকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় যোগ দেন।
এপ্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাশরুর রিয়াজ টিবিএসকে বলেন, একতরফাভাবে বাংলাদেশের শুল্কছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করা কঠিন হবে। তার চেয়ে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে কি চায়, সেটা জেনে তা বাস্তবায়ন করা। সভায় এই প্রস্তাব দিয়েছি আমি।
বাংলাদেশকে নিবিড়ভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় সম্পৃক্ত থাকতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন ড. এম এ রাজ্জাক।
এফবিসিসিআই এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বর্ধিত শুল্ক থেকে রেহাই পেতে বাংলাদেশ কী করবে এবং কী করণীয়, তা নিবিড়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে— দ্রুত টিকফা'র মিটিং আয়োজনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
@যেসব শুল্ক কমানোর পরিকল্পনা করছে এনবিআর
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, প্রাথমিকভাবে কিছু পণ্যের তালিকা বিডা থেকে এনবিআরকে পাঠানো হয়েছে, যেগুলোর ট্যারিফ কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে, ইলেকট্রনিক ইনটেগ্রেটেড সার্কিট (প্রসেসর ও কন্ট্রোলার), থেরাপি বা রোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত চিকিৎসা সামগ্রী (মেডিকামেন্টস), সংক্রমণ প্রতিরোধক পণ্য (ইমিউনোলজিক্যাল প্রোডাক্টস), এবং চিকিৎসা, সার্জারি ও পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও যন্ত্র।
এ তালিকায় আরও রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ডেটা প্রসেসিং মেশিনের যন্ত্রাংশ ও এক্সেসরিজ, এধরনের মেশিনের জন্য প্রসেসিং ইউনিট; সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইস বা ইলেকট্রনিক ইনটেগ্রেটেড সার্কিট উৎপাদনের জন্য মেশিন ও যন্ত্রাংশ, পাইপের জন্য অ্যাপ্লায়েন্স, বয়লার শেল, ট্যাংক, ডেটা প্রসেসিং মেশিন, স্পার্ক ইগনিশন রেসিপ্রোক্রেটিং পিস্টন ইঞ্জিন, গ্যাস টার্বাইনের যন্ত্রাংশ, ডেটা প্রসেসিং মেশিনের জন্য স্টোরেজ ইউনিট এবং কম্প্রেশন ইগনিশন ইন্টারনাল কমবাশ্চন পিস্টন ইঞ্জিন।
এছাড়া সেমিকন্ডাক্টর, গ্যাস টারবাইন ও চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতেও ট্যারিফ কমানোর বিষয়ে বিবেচনা করছে এনবিআর।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত গড় ট্যারিফ রয়েছে হুইস্কিতে। এছাড়া গাড়িতে ২১২ শতাংশ. তবে এসব পণ্য পরিমাণে খুবই কম আমদানি হয়। যার বিপরীতে তুলা, সয়াবিন, তরল বিউটেন, নৌযান ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস জাতীয় পণ্যে কোনো শুল্ক নেই, যেগুলো আমদানির পরিমাণও অনেক বেশি।
তবে যে শুল্ক কমানোর জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে, তা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নয়, বরং এইচএস কোডের ভিত্তিতে হবে। সেক্ষেত্রে ওই পণ্য যেদেশ থেকেই আমদানি হোক, তার ওপরই ট্যারিফ কমবে। তবে যেসব পণ্যে শুল্ক কমানোর বিবেচনা করা হচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে না বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তাঁর মতে, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে বাংলাদেশকে দেশটি থেকে আমদানি বাড়াতে হবে বড় আকারে। সেক্ষেত্রে জিরো ডিউটির (শূন্য শুল্কের) পণ্য আমদানি বেশি হারে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে বাণিজ্যে ঘাটতি কমবে। ফলে ওয়েটেড এভারেজ ট্যারিফ রেট (যে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র গড় শুল্ক হার ৭৪ শতাংশ দেখিয়েছে) কমে আসবে। যদিও স্ট্যান্ডার্ড হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বাংলাদেশের ওয়েটেড এভারেজ ট্যারিফ রেট ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের জুন থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫ হাজার ১৯৬ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে, যাতে কাস্টমস শুল্ক, নিয়ন্ত্রক শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক আদায় করেছে ৮৩৮ কোটি টাকা, যা গড় করলে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৪০ কোটি ডলারের রপ্তানির বিপরীতে আমদানি করেছে ২২০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যাতে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৬২০ কোটি ডলার। তাই বাণিজ্য ঘাটতির ওপর বাংলাদেশ থেকে আমদানির পরিমাণকে ভিত্তি করে ৭৪ শতাংশ ভারীত গড় শুল্ক হিসাব করে, ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে রাজস্ব বোর্ডের সিনিয়র একজন কর্মকর্তা, যিনি রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন, টিবিএসকে বলেন, "ইমপোর্ট ট্যারিফ কোন পণ্যে, কী হারে কমানোর জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে— তা আমরা এখনই সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। কেননা এখানে আমাদের বিবেচনা করতে হবে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নীতিমালার সাথে যাতে তা কোনভাবেই সাংঘর্ষিক না হয়।"
এদিকে গত শনিবার বিডা'র এক সভায় নন-ট্যারিফ সংক্রান্ত ইস্যুও দ্রুত সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠক সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কিছু নন-ট্যারিফ বাধা অপসারনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দেশটির তুলা আমদানির ক্ষেত্রে ডাবল ফিউমিগেশনের শর্ত বাতিল করা, তুলার জন্য আলাদা বন্ডেড ওয়্যারহাউজের অনুমোদন, মার্কিন কৃষি ও প্রযুক্তিপণ্য কেনায় অগ্রাধিকার।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কোম্পানি যেমন— ওয়ালমার্ট, শেভরন, মেটা, টেসলা ও বোয়িংয়ের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়েও ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।