কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কোড অব কন্ডাক্ট জারি: অনুমোদন ছাড়া সেবাগ্রহীতার থেকে উপহার নেওয়া যাবে না

সরকারি অ-আর্থিক সংস্থাগুলোর সংস্থা প্রধানসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোড অব কন্ডাক্ট জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, সেবাগ্রহীতাদের জন্য এমনভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে, যেন তারা সেবা পাওয়ার পর তৃপ্তি ও সন্তুষ্টি অনুভব করে তা প্রকাশ করার সুযোগ পান।
'অ-আর্থিক সরকারি সংস্থার জন্য কোড অব কনডাক্ট' শিরোনামে গতকাল সোমবার অর্থ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া স্বীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণকারীদের কাছ থেকে কোনো উপহার বা স্মারক বা মূল্যবান বস্তু গ্রহণ করা যাবে না।
অর্থ বিভাগের আওতাধীন মনিটরিং সেল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম দেখভাল করে থাকে। এই সেলের মহাপরিচালক ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব রহিমা বেগম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরিবারের সদস্যদের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে লাভজনক হতে পারে, এমন কোনো কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া বা অবৈধ বা অস্বাভাবিক সুবিধা গ্রহণ করা যাবে না।
অভিযোগ রয়েছে- ভূমি অফিস, সরকারি হাসপাতাল, থানাসহ সরকারের বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে সেবা গ্রহীতাদের পদে পদে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই ঘুষ দেওয়া ছাড়া সেবা পাওয়া না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা ১০০ শতাংশ বাড়ানোর সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আশা প্রকাশ করেছিলেন, বেতন বাড়ার কারণে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে ঘুষ ও দুর্নীতির প্রবণতা কমবে। ওই বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের পর সেবার মানে তেমন হেরফের হয়েছে- এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
কোড অব কন্ডাক্টে বলা হয়েছে, দুর্নীতি কমাতে পরিচালক ও কর্মচারীরা কোন পরিস্থিতিতে কী কী উপহার ও সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন, তার তালিকা করাসহ রেকর্ড সংরক্ষণ করতে হবে। ব্যক্তিগত ভ্রমণসহ প্রাতিষ্ঠানিক ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ক্রয়, টেন্ডার পদ্ধতির ক্ষেত্রে যথাযথভাবে আইন অনুসরণ করতে হবে এবং পরিচালক ও কর্মচারীদের শেয়ার, সিকিউরিটিজ বা অন্যান্য আর্থিক সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় বা লেনদেন ও ধারণ করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রচলিত বিধি-বিধান সুষ্ঠুভাবে পরিপালন করতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, নিজ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বা এর সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থ আছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হওয়া, কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করা বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছু করা যাবে না। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া স্বীয় সংস্থার বাইরে বৈতনিক বা অবৈতনিক কিংবা খণ্ডকালীন চাকরি নেওয়া যাবে না।
তবে এসব নিয়মাচার না মানলে ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা এই কোড অব কন্ডাক্টে উল্লেখ করা হয়নি।
সরকারি পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিযুক্ত বোর্ড সদস্য থেকে কর্মচারি পর্যন্ত সবাইকে সদাচারী হওয়ার পাশাপাশি সৎ, ন্যায়সঙ্গত এবং বৈধ উপায়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে 'শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে' বলেছে অর্থ বিভাগ।
অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সমানুভূতি প্রকাশ করতে হবে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার প্রতি সমান সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে। অফিসগুলোতে হেনস্থা, বৈষম্য বা অন্য কোনো অস্বস্তিকর আচরণমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেবাগ্রহীতাদের তৃপ্তি বা অতৃপ্তি, সন্তুষ্টি বা অসন্তোষ ইত্যাদি প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
বোর্ড সদস্য, পরিচালক ও কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে এতে বলা হয়েছে, 'সাধারণ জনগণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে সৌজন্য, সততা ও দক্ষতার সাথে আচরণ এবং পরিষেবার মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বীয় প্রতিষ্ঠানের সুনাম বজায় রাখতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবেন।'
সরকারি কেনাকাটায় অনিয়ম দূর করতে কোড অব কন্ডাক্টে বলা হয়েছে, 'ক্রয় প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই আইন বা বিধির ফাঁকে প্রতিযোগিতার ব্যতয় ঘটিয়ে দরপত্র আহ্বান বা দাখিলের সুযোগ সৃষ্টি করা যাবে না। ক্রয় প্রক্রিয়া এমনভাবে সম্পাদন করতে হবে যাতে কোনোভাবেই স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্বের সূত্রপাত না ঘটে।'
সংস্থাগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো প্রকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করতে পারবে না বা বৈদেশিক মুদ্রায় কোনো দায় সৃষ্টির অঙ্গীকার করতে পারবে না।
জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মাহবুব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'এ ধরনের কোড অব কন্ডাক্টে নীতি কথা বলে কোনো লাভ হবে না। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার মানও বাড়বে না, অনিয়ম-দুর্নীতিও কমবে না।'
তিনি বলেন, 'কোড অব কন্ডাক্টে যে ধরনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালাতেই রয়েছে। তাছাড়া, ফৌজদারি আইনেও ঘুষ-দুর্নীতি, কেনাকাটায় অনিয়ম, সেবাদাতাকে হয়রানি করার ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তির বিধান আছে। এসব আইন কঠোরভাবে কার্যকর না করে এমন সুন্দর সুন্দর নীতি কথা বলে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।'
'অতীতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেবা দেওয়ার অঙ্গীকার করে সিটিজেন চার্টারসহ এ ধরনের নানা বিষয় প্রকাশ করেছে, কিন্তু সেবাগ্রহীতাদের হয়রানিও কমেনি, ঘুষ-দুর্নীতিও কমেনি। তাই সবচেয়ে জরুরি হলো বিদ্যমান আইনের কঠোর বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন করে তা কার্যকর করা,' যোগ করেন তিনি।