ভালো তরমুজ চিনবেন কীভাবে?

ব্যাংক কর্মকর্তা আবু জাফর অফিস ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন। পথেই চোখ আটকালো ভ্যানবোঝাই তরমুজে। গাড়ি থেকে নেমে লেগে গেলেন তরমুজ বাছাই করতে। বেশ কয়েকটি বাছাই করে নিজে একটি তুলে দিলেন খুচরা বিক্রেতা কামাল হোসেনের হাতে।
কামাল তরমুজটি হাতে নিলেন, আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে বললেন, 'স্যার এইডা আপনারে দিতে পারমু না। মাল ভালো হইবে না। এর চেয়ে মুই একটা বাইচ্ছা দেই, আপনে নেন। কাইট্টা নেবেন নাইলে বাসায় গিয়া কাইট্টা খাইয়া আইসা টাকা দিবেন।'
আবু জাফর ফ্যাল ফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছেন।
বিক্রেতা কামাল হোসেনের কথায় বিশ্বাস রেখে বললেন, 'ঠিক আছে আপনার চয়েস মতন দেন। মাল যেন ভালো হয়। একইসঙ্গে আবু জাফর প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, কামাল মিয়া আপনি কেমনে বুঝেন কোন তরমুজটি ভালো, কোনটির মধ্যে ফাপা?'
সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কামাল হোসেন চাকু চালায় তরমুজের শরীরে। বিশেষ দক্ষতায় চৌকোনা অংশ কেটে বের করে দেখান টকটকে লাল। এবার আবু জাফরের পছন্দ করা তরমুজটি কাটতে উদ্যত হন। বাধ সাধেন আবু জাফর। তারপরও কামাল হোসেন চাকু চালাতে চালাতে বলেন, 'স্যার আপনে আমার কথায় বিশ্বাস করছেন, আপনের কতায় সোনমান (সম্মান) আছেতো। মালডাতো [তরমুজ] এমনিতেই কাজে আইবে না, কাইট্টা দেহাইতে দোষ কী।'

দক্ষ হাতে চাকু চালিয়ে তরমুজটি কেটে এক ফালি বের করতেই সকলের চোখ ছানাবড়া। আসলেই বিক্রেতা কামাল হোসেনের কথায় মিলে গেছে। আবু জাফরের প্রথম পছন্দ করা তরমুজটির ভিতরে লালচে সাদা এবং ফাঁপা।
মৌসুমের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ফল তরমুজ বাজারে উঠতে শুরু করলেই ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যকার এমন চিত্র প্রায়শই দেখা মেলে। সাধারণত ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে বাজারে আসতে শুরু করে গ্রীষ্মের রসালো ফল তরমুজ। রসে টৈটুম্বুর, স্বাদে অতুলনীয় প্রাকৃতিক গুণসমৃদ্ধ এই ফল বাজারে এসেই বাজিমাৎ করে। এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি তরমুজ পছন্দ করেন না। নিজের পরিবারের জন্য, কুটুম বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, বন্ধুরা আড্ডায় বসেছে কিংবা যাত্রা পথের অবসরে তরমুজ হয় প্রথম পছন্দ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উদ্যান কর্মকর্তা জিএমএম কবীর খান জানিয়েছেন, লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এই মৌসুমে বেশি আবাদ হয়েছে তরমুজ। ২০২৩-২৪ মৌসুমে বরিশাল বিভাগে আবাদ হয়েছিল ৪৮ হাজার ৪৭ হেক্টর জমি। চলতি মৌসুমে (২০২৪-২৫) চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ৩৪৪ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৫৪ হাজার ৫৫১ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে আবাদের হার নির্নিত হয়েছে ১১২.৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ ফলনে বিগত বছরগুলোর চেয়ে অনেকগুণ ভালো হয়েছে।
পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের তরমুজ চাষী শাহ আলম রাঢ়ী বলেন, 'তিন একর জমিতে চাষ করেছি। প্রথম চালানে ২২শ' হাজার পিস এনেছি। আরো দুই-তিন চালান তরমুজ তুলতে পারব।'

একজনের জমিতে প্রথম চালানে ১১শ' পিস তরমুজ আহরণ করা গেলে দক্ষিণাঞ্চলে আবাদ হওয়া মোট জমিতে কয়েক কোটি পিস তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। এরমধ্যে সবগুলোই যে ভালো তা কিন্তু নয়।
ভালো তরমুজ শনাক্ত করার উপায় কি? জানতে চাওয়া হয়েছিল খুচরা বিক্রেতা কামাল হোসেনের কাছে।
তিনি বলেন, 'আমরা ফি বছর তরমুজ নাড়াচাড়া করি। তরমুজ এখন হাতে তোলা লাগে না ভালো করে নজর দিলেই বলতে পারি কোনটি ভালো কোনটি ঠোসা। তারপরও ভালো তরমুজ চকচকে হবে। ফুলের পাশের বোটা শুকনা ও ছোট হবে। তরমুজে যদি দেখেন হলুদাভ রঙ এবং ভারী তাহলে নিশ্চিন্তে নিতে পারেন। তরমুজে টোকা দিলে যদি ফাপা মনে না হয় তাহলে সেটি ভালো মানের তরমুজ। কারণ তরমুজে পানি থাকে।'
একই প্রশ্ন করা হয়েছিল ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার তরমুজ চাষী জাকির হোসেনের কাছে।
তিনি বলেন, 'তরমুজ সুন্দরভাবে গোল হতে হবে অথবা ডিমের আকৃতির তবে পুরোপুরি ডিমের মত না-ডিমেরতো একপাশ সরু থাকে অমনও থাকবে না। তরমুজ হবে ডিম আকৃতির তবে উভয় পাশ সমান আকৃতির। তরমুজে সঠিকভাবে পুষ্টি পেলে এরমধ্যে সমানভাবে বৃদ্ধি পাবে। পাকা তরমুজ গাঢ় সবুজ ও কালচে কালারের হবে।'
ভালো তরমুজ শনাক্ত কিভাবে করা যায় জানতে চাইলে বরিশাল সদর উপজেলার চরলড়াইপুরের বাসিন্দা আবু হোসেন বলেন, 'বাঁকা, একপাশ বড় অপর পাশ সরু তরমুজ ভালো হয় না। ভালো পরিচর্যা না পেলে ভালো আকৃতির হয় না তরমুজ। তরমুজ তুলে ছোট ছোট চড় বা টোকা দিবেন। যদি ভারী মনে হয় তাহলে সন্দেহ নেই জিনিস ভালো। আরেকটা সাধারণ চিহ্ন হচ্ছে, ভালো তরমুজের একপাশ হলুদাভ সাদা হয়ে থাকবে। এটা দেখলে বুঝবেন তরমুজটি ক্ষেতে পেকেছে। যে অংশ হলুদাভ সাদা ওই অংশ মাটির সাথে লেগে ছিল। হলুদাভ সাদা না থাকলে সেই তরমুজ পাকা না। কাটলেও মধ্যে লাল ও মিষ্টি পাবেন না। যদি দেখেন সরাসরি সাদা দেখতে তাহলে সেটি ফেপে গেছে। হলুদ মিশ্রিত সাদা হতে হবে।'

পটুয়াখালীর গলাচিপার তরমুজ চাষী সেতারা বেগম বলেন, 'তরমুজ চাষ খুবই কঠিন চাষ। সারাক্ষণ যত্ন করতে হয়। সন্তানের মত প্রতিটি গাছ লালন-পালন করে ফল আনতে হয়। তরমুজ ভালো হবে না মন্দ হবে তা নির্ভর করে চাষীর ওপর। আমরা দুটি করে চারা রোপন করলেও একটু বড় হলে যে চারাটি তরতাজা সেটি রেখে বাকিটা কেটে ফেলি। তরমুজ গাছের গোড়ায় পরিমাণমতো পরিচর্যা চালাতে হয়। পরিচর্যার গুণেই মূলত তরমুজ ভালো আকৃতির, স্বাদের হয়ে ওঠে। মনে করেন, গোলাকার, দেখতে চকচকে সুন্দর, ওজনওয়ালা এবং কিছুটা হলুদ রঙের তরমুজ ভালো তরমুজ।'
খুলনার গড়াইখালীতে এই বছর ২৫ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন কৃষক শান্ত মণ্ডল। তিনি বলেন, তরমুজ পরিপক্ক হলে ভেতরে লাল ও খেতে সুস্বাদু হয়। সাধারণত ক্ষেতের প্রায় সব তরমুজ গাছ একসঙ্গে লাগানো হয় এবং পরিপক্ক হলে একসঙ্গে বিক্রি করা হয়। আমরা একটি গাছে একটি বা দুটি তরমুজ রাখি। কোনো কোনো গাছে যদি বিলম্বে তরমুজ আসে, তবে সেটি বিক্রির সময় অপরিপক্ক থাকে, ফলে তা সুস্বাদু বা লাল হবে না। আর কিছু তরমুজে অনুজীবের আক্রমণ হলে আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়, সেগুলিও অনেক সময় পরিপক্ক হয় না। তাই রোগাক্রান্ত তরমুজে সেই স্বাদ ও রং পাওয়া যাবে না।'
পরিপক্ক তরমুজ চেনার উপায় জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের সিনিয়র মনিটরিং কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন।
তিনি বলেন, 'একটি তরমুজ গাছ লাগানোর ৬৫ থেকে ৭০ দিন পর যদি সেটি থেকে ফল তোলা হয়, তাহলে পরিপক্ক ফল পাওয়া যাবে। তখন তার ভেতরের বীজগুলো কালো হবে।'

ক্রেতারা সাধারণভাবে কীভাবে পরিপক্ক তরমুজ চিনবেন—সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তরমুজের পিছনের দিকে ফুলের অংশ থাকে। পরিপক্ক হলে ওই তরমুজের ফুলের অংশ অতি ছোট হয়ে যাবে। কখনো কখনো ফুলের অংশ দেখা যাবে না, অর্থাৎ ভরাট হয়ে উঁচু হয়ে যাবে। তরমুজের পেটের অংশে হালকা হলুদ বর্ণ আসবে। বোঁটা হয়ে যাবে অ্যাশ রঙের, আর আঘাত করলে ড্যাপ ড্যাপ শব্দ হবে। এই সূচকগুলো থাকলে সেই তরমুজ অবশ্যই পরিপক্ক, তাই খেতে সুস্বাদু ও ভেতরে লাল হবে।'
খুলনার শান্তিধাম মোড়ে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মৌসুমে তরমুজের ব্যবসা করছেন শেখ আবেদনী।
তিনি বলেন, 'পাইকারি আড়ত থেকে তরমুজ কেনার সময় আমরা সব সময় পরিপক্ক তরমুজ কেনার দিকে লক্ষ করি। তা না হলে বিক্রি কমে যায় ও আমাদের লোকসান হয়। এজন্য পেটের হালকা হলুদভাব দেখে তরমুজ নির্বাচন করি। এটি সবচেয়ে সহজ উপায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে পেটে হলুদভাব না আসলেও ভেতরে লাল হয়। তখন আমরা ফুলের গর্তের পরিমাপ ও আঘাত করলে ড্যাপ ড্যাপ শব্দ হয় কি না, সেটা দেখে অনুমান করি। আবার কখনো কখনো তরমুজ কেটে দেখি, কারণ একটি ক্ষেতের প্রায় সব তরমুজ একসঙ্গে পেকে যায়। তাই একটি পাকা পেলে, বাকিগুলিও পাকা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।'
উল্লেখ্য, দেশের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ তরমুজ উৎপাদিত হয় বরিশাল বিভাগে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায়।