সুখ চাই না, মোটা ভাত খেয়ে শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে চাই

রাজধানীর গুলশানের একটি বাড়িতে মধ্যরাতে দরজা ভেঙে ঢুকে শতাধিক ব্যক্তি তল্লাশির নামে লুটতরাজ চালিয়েছে। বাড়িটি কার, সে প্রসঙ্গে না গিয়ে বলতে চাই—দেশে কি কারো বাড়িতে অনুমতি বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া একদঙ্গল মানুষ প্রবেশ করতে পারে?
অনুপ্রবেশকারীরা দাবি করেছে, 'ওই বাড়িতে গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা হত্যাকারীরা আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখানে অবৈধ অস্ত্র লুকানো রয়েছে।' এই তথ্যের ভিত্তিতেই তারা 'তল্লাশি' চালিয়েছে। কী ভয়াবহ এক পরিস্থিতি! এই অজুহাতে কি কেউ যখন-তখন অন্যের ঘর বা অফিসে ঢুকে তছনছ করে মালপত্র লুট করতে পারে? পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেসি অর্ডার ছাড়া কেউ জোর করে কারও বাড়িতে ঢুকতে পারে না।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর গুলশানের বাসায় তল্লাশির নামে লুটপাটের ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। অভিযোগ, ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকারই জনগণকে উসকানি দিয়ে 'তল্লাশি' করিয়েছে। প্রায় সব মিডিয়া এই খবর প্রচার করলেও ঘটনার পেছনের বিশদ ব্যাখ্যা এখনো অনুপস্থিত।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একদল উন্মত্ত মানুষ যখন যা খুশি তা-ই করতে পারছে। প্রতিটি ঘটনার অনেকক্ষণ পর পুলিশ বা সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাচ্ছেন। রাজধানীর গুলশানে যদি এমন হয়, তাহলে অন্যান্য এলাকার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এক কথায়, দেশের নাগরিক নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে।
সরকার কি বুঝতে পারছে যে, কিছু দস্যু-তস্কর বিদ্রোহী জনতার রূপ নিয়ে নানা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে? এরআই মব, যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরসহ নানা অপরাধ ঘটাচ্ছে।
একদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অন্যদিকে পুলিশ বলছে, মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধে টহল জোরদারসহ অপরাধীদের ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে বাড়ছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উপেক্ষা করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। এখন কে অপরাধী, কে নয়, সেই বিচারের ভারও যেন উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিয়ে নিয়েছে। কেউ কোথা থেকে শুধু একটা ধুয়া তুললেই হয়—এক শিয়ালে এক জায়গা থেকে হুক্কাহুয়া করলেই নেমে আসে সবাই।
দেশের মহাসড়কগুলোতে প্রতিদিনই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। গণপরিবহন, দূরপাল্লার বাস, ছাত্রদের পিকনিকের গাড়ি, ট্রাক—কেউই রেহাই পাচ্ছে না। ৫-৬ দিন আগে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বেড়া-সাঁথিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে গাছ ফেলে অন্তত ১০টি গাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। যাত্রীদের মারধর করে আহত করা হয়েছে। ফলে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনার পর ঘটনাস্থলে পৌঁছাচ্ছে।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মতো নিয়ন্ত্রিত এলাকায়ও মব গঠিত হয়ে ইরানের দুই নাগরিকসহ তিনজনকে মারধর করা হয়েছে। পুলিশ তাদের হাসপাতালে ভর্তি করেছে। আহত ইরানি নাগরিকরা বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছিলেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মব হামলা নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি বড় দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো—এই মব এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকেও মানছে না। থানা থেকে অভিযুক্তদের জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। দোকানপাট, কল-কারখানা লুটের পাশাপাশি জলমহাল ও গরুর গোয়ালও রক্ষা পাচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকার আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় বন্ধ থাকা ম্যাগপাই নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানায় ডাকাতি ও মালামাল লুটের অভিযোগ উঠেছে। অথচ কারখানাটি গত বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে।
রাত ৯টায় ডাকাতদল বন্ধ থাকা কারখানাটিতে আরামসে প্রবেশ করে, নিরাপত্তা কর্মীদের দেশীয় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে, এবং কারখানা থেকে পরিত্যক্ত এসি, কম্পিউটার, বৈদ্যুতিক মোটর, দামি ক্যাবল, আইপিএসের ব্যাটারিসহ বিভিন্ন মালামাল লুট করে একটি ট্রাকে তোলে। এরপর ভোর রাত ৪টার দিকে তারা কারখানা ত্যাগ করে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, 'গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেও দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। আইনশৃঙ্খলা এখনও স্বাভাবিক হয়নি, যা বায়ারদের আস্থা ফেরানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
সম্প্রতি সুনামগঞ্জে জলমহালে মাছ লুটের ঘটনা ঘটেছে। হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে এসব জলমহালে মাছ ধরতে নেমে পড়ে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করলেও কোনো কাজ হয়নি। এর আগে পাঁচ দিনের ব্যবধানে জেলার দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় আরও ছয়টি জলমহালে মাছ লুটের ঘটনা ঘটে। দিনে-দুপুরে হাজার হাজার মানুষ আনন্দ-উল্লাস করে আটটি জলমহালের প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মাছ লুট করেছে।
সরকার ও পুলিশ বলছে, একটি গ্রুপ ক্রমাগত দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আমরা জানতে চাই, কারা এই গ্রুপ? তাদের ধরুন, বিচার করুন, শাস্তি দিন। শুধু আমাদের নিরাপত্তা দিন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, কিছু কিছু ঘটনা অতিরঞ্জিতভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে তারা সর্বদা সতর্ক আছেন।
পুলিশের ওয়েবসাইটে ফেব্রুয়ারি মাসের অপরাধ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জানুয়ারি মাসে গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডাকাতির ঘটনায় দেশব্যাপী ৭১টি মামলা হয়েছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করতে হবে, অন্যথায় দেশের পোশাক শিল্প হুমকির মুখে পড়বে।
শুধু চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নয়—পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সারা দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৫২২টি। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চুরি, দস্যুতাসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৬টি। তবে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে, তা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের দরকার নেই—প্রতিদিন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট হয়।
প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও হত্যাকাণ্ড ঘটছে। গলিত ও ঝুলন্ত মৃতদেহ, আগুনে পোড়া মরদেহ, টুকরো করা লাশ প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি কবর থেকে কঙ্কাল চুরির ঘটনাও ঘটছে। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ, ভাঙচুরের ঘটনাও নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রমজান মাস বলে অবরোধের ঘটনা নেই, কিন্তু সংঘর্ষ ও গণপিটুনি যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ৬৮ জন নিহত হয়েছেন।
সরকার সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে গ্রেপ্তার ও বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তারপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না কেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের মানুষ ও তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায়, প্রতিটি বড় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বক্তব্য দেন, জনগণ ক্ষুব্ধ হয়, প্রতিবাদ জানায়—এরপর সবকিছু আগের মতোই চলতে থাকে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, তা নৈরাজ্যের পর্যায়ে পড়ে। বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে হবে। উত্তরায় ছিনতাইকারীকে গণপিটুনি দিয়ে পরে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা ভয়াবহ। এটাও এক ধরনের অপরাধ।
পুলিশি তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা চললেও অনেকেই মনে করেন, পুলিশ এখনো যথেষ্ট সক্রিয় নয়। কেউ কেউ ধারণা করছেন, পুলিশ বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছে। যদি পুলিশ অপরাধী ধরার পর থানায় হামলা চালিয়ে সেই অপরাধীকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পুলিশ সদস্যদের আহত করা হয়, থানা ঘেরাও করা হয়—তাহলে পুলিশ ও প্রশাসন কীভাবে ও কেন কাজ করবে?
আমরা সাধারণ মানুষ বেশি কিছু চাই না, শুধু নিরাপত্তা চাই। আমাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। নারীদের নিরাপদ চলাফেরার নিশ্চয়তা দিন, নারী নির্যাতন বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিন, নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। সরকারকে অনুরোধ করছি, অপরাধী ও 'মবতন্ত্রের' বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। আমরা সুখ চাই না—শুধু মোটা ভাত খেয়ে শান্তি ও স্বস্তিতে থাকতে চাই।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।