‘৫২-হার্টজ তিমি’ কেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ প্রাণী

গভীর সমুদ্রের রহস্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সেই একাকী ডাক, যা কয়েক দশক ধরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তৃত জলরাশিতে। ডাকটি এতটাই ব্যতিক্রমী কম্পাঙ্কে শোনা যায়, মনে হয় এটি কোনো সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ প্রাণীর আওয়াজ।
'৫২-হার্টজ তিমি' নামে পরিচিত এই রহস্যময় প্রাণীটি দীর্ঘদিন ধরে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, সমুদ্রবিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে। এটি নিঃসঙ্গতার গল্প, একটি তিমির গল্প, যে হয়ত নিজের প্রজাতির সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারে না।
যেভাবে মানুষ তিমিটি আবিষ্কার করল
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে মার্কিন নৌবাহিনী প্রশান্ত মহাসাগর পর্যবেক্ষণ করছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, শত্রুপক্ষের সাবমেরিন। কোল্ড ওয়ারের (স্নায়ুযুদ্ধ) সময় সোভিয়েত সাবমেরিনের গতিবিধি নজরদারির জন্য তৈরি 'সাউন্ড সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম' (এসওএসইউএস) ব্যবহার করে তারা নিয়মিত সমুদ্রের আওয়াজ বিশ্লেষণ করত। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নৌবাহিনীর বিশেষজ্ঞরা সচরাচর বিভিন্ন ধরনের শব্দ শনাক্ত করতেন, যেমন যাযাবর তিমিদের ডাক, টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার শব্দ এবং ঢেউ ভেঙে এগিয়ে যাওয়া দূরবর্তী জাহাজের প্রতিধ্বনি।
কিন্তু এই স্বাভাবিক সামুদ্রিক শব্দের ভিড়ে তারা এক অপ্রত্যাশিত কিছু শনাক্ত করেন। সেটি ছিল একটি তিমির ডাক, যার কম্পাঙ্ক ছিল ৫২ হার্টজ। এটি ছিল এক ব্যতিক্রমী ঘটনা, কারণ এ পর্যন্ত চিহ্নিত কোনো বালিন তিমির ডাক এত উচ্চ কম্পাঙ্কে শোনা যায়নি। সাধারণত নীল তিমি (Balaenoptera musculus) এবং ফিন তিমি-এর (Balaenoptera physalus) মতো বালিন তিমিরা ১৫ থেকে ২৫ হার্টজ কম্পাঙ্কের গভীর, গমগমে আওয়াজে যোগাযোগ করে। সঠিক পরিবেশে এই ডাক শত শত মাইল দূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
কিন্তু এই ৫২-হার্টজ কম্পাঙ্কের ডাক ছিল ভিন্ন। এটি এতটা উচ্চ সুরে ছিল যে, এটি কোনো পরিচিত বালিন প্রজাতির আওয়াজের সাথে মেলেনি। তবুও এর সঙ্গীতময় গঠনের জন্য এটিকে সাধারণ সমুদ্রের এলোমেলো শব্দ হিসেবে খারিজ করে দিতে পারেননি মার্কিন নৌবাহিনীর সদস্যরা।

প্রথমে, নৌবাহিনী এই রেকর্ডিংগুলো গোপন করে রেখেছিল। তবে স্নায়ুযুদ্ধের পর এসওএসইউএস প্রোগ্রাম বন্ধ হলে কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়। এর ফলে সাধারণ গবেষকরা বছরের পর বছর ধরে নেওয়া সমুদ্রের নিচের রেকর্ডিং দেখার সুযোগ পান।
তখনই গবেষক উইলিয়াম ওয়াটকিনসের নেতৃত্বাধীন উডস হল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশন (ডাব্লিউএইচওআই)-এর একটি দল এই ডাকটি লক্ষ্য করে। তারা বুঝতে পারেন, এই সিগনালের গুরুত্ব রয়েছে। তাই ওয়াটকিনস এবং তার সহকর্মীরা কয়েক বছর ধরে এই ডাকটি অনুসরণ করতে শুরু করেন। প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন স্থান থেকে এর গতি এবং গঠন বিশ্লেষণ করেন।
বিজ্ঞানীরা দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছান, কোনো দাঁতযুক্ত তিমি এই ডাকটি তৈরি করতে পারে না কারণ তারা ইকোলোকেশন ব্যবহার করে, গান গায় না। তিমিরা সাধারণত ক্লিক, হুইসেল (শিষ দেওয়া) এবং বার্স্ট পালস বা বিস্ফোরণমূলক পালস [এক ধরনের দ্রুত এবং শক্তিশালী শব্দ, যা অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হয়] তৈরি করে; যার কম্পাঙ্ক ৫২ হার্টজের চেয়েও বেশি থাকে।
গবেষকরা তিমিটি নিয়ে তিনটি সম্ভাবনা তুলে ধরেন। এটি হয়ত একটি হাইব্রিড তিমি, যেটি নীল তিমি এবং ফিন তিমির মিশ্রণ। ফলে প্রাণীটির একটি অস্বাভাবিক ভোকাল সিগনেচার [বিশেষ ধরনের শব্দ বা ডাক] তৈরি হয়েছে। অথবা তিমিটির ডাকে অস্বাভাবিকতা রয়েছে। মূলত মিউটেশন বা ব্যতিক্রমী শারীরিক গঠনের জন্য এটি স্বাভাবিক কম্পাঙ্কের বাইরে ডাকতে বাধ্য হয়েছে। কিংবা এটি একটি অপরিচিত প্রজাতির সদস্য অর্থাৎ এটি তিমির একটি নতুন প্রজাতির অস্তিত্বের সম্ভাবনা তুলে ধরে।
গবেষকরা শুধু একটি বিষয়েই নিশ্চিত ছিলেন। তা হলো, আর কোনো তিমি এই ডাকে প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
বিশ্বের সবচেয়ে একাকী তিমি সম্পর্কে আজ পর্যন্ত যা জানা গেছে
এখন পর্যন্ত ৫২-হার্টজ তিমি প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর তিন দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। সামুদ্রিক গবেষণায় প্রযুক্তিগত উন্নতির পরও এটিকে ঘিরে রহস্য রয়ে গেছে। এর আবিষ্কারের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাওয়া হলো, এই ডাক আসলেই একটি নিঃসঙ্গ তিমির ডাক।
তিমির অনন্য ভোকাল সিগনেচারের দীর্ঘমেয়াদি ট্র্যাকিং ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এর মৌসুমি চলাচল অনুসরণ করে দেখেছেন, এটি নীল তিমি ও ফিন তিমির মতো একইভাবে মাইগ্রেট (পরিভ্রমণ) করে এবং উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে। তবে, এটিকে কখনোই সরাসরি দেখা যায়নি। ফলে এর প্রজাতি, বয়স এবং সঠিক আকারসহ অনেক বিস্তারিত বিষয় একেবারেই রহস্যময় রয়ে গেছে।
৫২-হার্টজ তিমি কতদিন বাঁচতে পারে?
যদি তিমিটি আসলেই নীল তিমি বা ফিন তিমির হাইব্রিড হয়ে থাকে, তাহলে এর প্রত্যাশিত আয়ু ৭০ থেকে ৯০ বছর হতে পারে। তবে কিছু বালিন তিমি আরও দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে, যেমন বাওহেড তিমি। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম জীবিত স্তন্যপায়ী। যেহেতু এর ডাক প্রথম ১৯৮০-এর দশকে শনাক্ত হয়েছিল, এটি এখনও জীবিত থাকতে পারে অথবা জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
কিছু গবেষক ধারণা করছেন, অন্যান্য বুড়ো বালিন তিমির মতো, এর ডাকের তীব্রতা এবং কম্পাঙ্ক সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। যদি এই তিমি ইতোমধ্যেই কয়েক দশক বয়স্ক হয়ে থাকে, তবে একদিন হয়ত এর শেষ ডাকটি শোনা যাবে।
মহাসাগরের শব্দ দূষণের বাড়তি হুমকি তিমিটিকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুলতে পারে
যদি ৫২-হার্টজ তিমি এখনও জীবিত থাকে, মানুষের কর্মকাণ্ড প্রাণীটি ঘিরে একটি নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে: মহাসাগর আগের চেয়ে অনেক বেশি শব্দময় হয়ে উঠেছে।
জাহাজ চলাচল, সোনার সিস্টেম এবং শিল্প কর্মকাণ্ড মহাসাগরে কৃত্রিম শব্দ ছড়াচ্ছে। এর ফলে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করা তিমিদের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, তিমিরা যখন মানুষের তৈরি শক্তিশালী শব্দ শোনে তখন তাদের মধ্যে চাপ তৈরি হয়। এটি তাদের খাবার খোঁজা, পথ চলা বা শত্রুদের এড়ানোর সক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।