নিরপেক্ষ ভোটারদের মুখোমুখি হয়ে থতমত খেলেন ট্রাম্প

প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে নির্বাচনী রাজনীতি মানেই প্রার্থীদের নিজ আদর্শিক বলয়ের বাইরেও অন্যদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট হওয়া। মনস্থির না করা ভোটারদের পক্ষে টানার এ উদ্যোগই সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র চর্চা। কখনোবা নিজ সমর্থকদের গণ্ডির বাইরে আসা কোনো কোনো রাজনীতিবিদের জন্য তা বিব্রতকর হতে পারে। অন্তত, এমনটাই হয়েছে গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে।
সবকিছুতেই ট্রাম্পের একনিষ্ঠ ভক্তরা, তার আত্মপ্রশংসার ধারাটি পছন্দই করেন। প্রেসিডেন্টের ভুল তথ্য উপস্থাপন এবং মিথ্যে দাবিগুলোকেও তারা জনসভায় উপস্থিত থেকে জোর করতালি আর উল্লাস ধ্বনির মধ্য দিয়ে সমর্থন দেন। মঙ্গলবার আনন্দময় এসব মুহূর্ত 'মিস' করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি, মনস্থির না করা ভোটারদের মুখোমুখি হয়ে।
এদিন ফিলাডেলফিয়ায় 'এবিসি নিউজ টাউন হল' শীর্ষক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাকে হতাশ করে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আসনগ্রহণকারী একদল দর্শক। ট্রাম্পের ধারণা ছিল, তার চিরাচরিত জোর গলায় করা দাবি এবং কথার সুর তার সমর্থকদের যেমন তুষ্ট করে, ঠিক তেমনি এসব ভোটারদের উপরও তা একইরকম প্রভাব ফেলবে।
কিন্তু, বাস্তবে দেখা গেছে, নিজ সমর্থকদের পছন্দের ভাঁজ বুঝলেও; নতুন এবং মনস্থির না করা ভোটারগোষ্ঠীর চিন্তাধারা ধরে উঠতে পারেননি মার্কিন রাষ্ট্রপতি। এসব ভোটাররা অনেক কিছুই জানতে চান। তারা জানতে চান; কীভাবে ট্রাম্প মহামারি সামলানোর পরিকল্পনা করেছেন এবং বর্ণবাদ ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তার অবস্থান। এমন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েই খেই হারিয়ে ফেলতে দেখা গেছে ট্রাম্পকে।
সমর্থকদের করতালি আর উচ্ছ্বাস পেয়ে অভ্যস্ত এবং সবসময় এমনটাই পাওয়ার আশা করা- একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য এটা ছিল বিরল এক মুহূর্ত। মঙ্গলবার রাতে তিনি দর্শকদের কাছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্মান পেয়েছেন, কিন্তু তাকে নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না সেখানে, যার অভাব ট্রাম্প মর্মে মর্মে অনুভব করেন।
ট্রাম্প বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার অন্ধ ভক্তকূলের সামনে আত্মবিশ্বাসী এক উপস্থিতি নিয়ে হাজির হতে পছন্দ করেন। কিন্তু, তার এসব নাটুকেপণা ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেনকে অনেক বিষয়ে তার বিরুদ্ধে শক্ত যুক্তির দেওয়াল তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। আর এমন সময়ে ট্রাম্প এ সঙ্কটে; যখন হোয়াইট হাউজের শীর্ষ পদটি দখলের জন্য অতি-গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রার্থীর প্রথম সামনাসামনি টেলিভিশন বিতর্কের আর মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি।
বিতর্কটি খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে ট্রাম্পের জন্য। অতীতে বহুবার দেখা গেছে, প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী প্রেসিডেন্টরা বিতর্কে এসে প্রতিপক্ষের হাতে তুলাধুনা হয়েছেন, অথচ তারা নিজ দায়িত্বপালনের সুবাদে সকলের সমর্থন ও সম্মান আশা করেছিলেন।
ট্রাম্পের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জটিল। তিনি বিভাজনমূলক জনপ্রিয় রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন বরাবর। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর বিতর্ক চলাকালে; প্রতিপক্ষ বাইডেন বা সর্বস্তরের মার্কিন দর্শকদের কাছে- তিনি ছাড় পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে পারেন। এমন ইঙ্গিতই দিয়েছে মঙ্গলবারের ঘটনা।
সাধারণত নিজ জনসভায় তার যেসব উত্তর তুমুল উত্তেজনা আর হর্ষধবনির জন্ম দেয়; তার কোনটাই ঘটেনি মঙ্গলবার। যখন তিনি মিথ্যে প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত নন- এমন ভোটার শ্রেণির মুখোমুখি হয়েছিলেন। ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়াগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামনে যে বিশাল চ্যালেঞ্জ আছে, তার পর্বতপ্রমাণ গুরুত্ব তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। তিনি সে চেষ্টাও করেননি। এর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয়, নিরপেক্ষ ভোটার পক্ষে আনতে যে ভাষা ও যুক্তি দরকার; ট্রাম্প তা আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাইডেনের ধারালো যুক্তির উপস্থাপনে এজন্য তাকে কড়া মাশুল দিতে হতে পারে।
খ্যাতনামা মার্কিন সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তার 'রেজ' বা ক্ষোভ শিরোনামের সদ্য প্রকাশিত এক বইয়ে লিখেছেন, কীভাবে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর ঘটনার অন্তত এক সপ্তাহ আগে থেকেই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতেন। তারপর,ও তিনি জনসম্মুখে এর বিপদ স্বীকার করে বক্তব্য দেননি।
আর যুক্তরাষ্ট্রে আজ বুধবার নাগাদ যখন ১২শ' প্রাণহানি ঘটছে, তখন ট্রাম্প জনগণকে নিজের ওই স্বীকারোক্তিকেই অগ্রাহ্য করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এবিসি টাউন হল অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, তিনি নাকি জীবাণু প্রতিরোধে 'অসাধারণ' দায়িত্ব পালন করেছেন। বার বার বলতে থাকেন, 'অচিরেই ভাইরাস বিদায় নেবে' এবং 'অনেকেই মনে করেন মাস্ক ব্যবহার করা ভালো নয়'।
এসময় তাকে প্রশ্ন করা হয়, কারা মাস্ক ভালো নয় বলে মনে করেন? জবাব দিতে গিয়েই ভড়কে যান ট্রাম্প। 'রেস্তোরাঁর ওয়েটাররা পছন্দ করে না' তিনি বলেন। 'গোষ্ঠীবদ্ধ (সাহসী) মনোভাব দেখালেই' ভাইরাস পালাবে এমন উদ্ভট জবাব দিতেও শোনা যায় তাকে।
ট্রাম্প হয়তো গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন; এমনটা হওয়ার আগেই আরও লাখো জীবন করে নেবে ভাইরাস।
তাছাড়া, প্রতিপক্ষ বাইডেনের ভুল উচ্চারণ নিয়ে তিনি যেভাবে কৌতুক করেছেন, তা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মতো মানসিক সক্ষমতা আছে কিনা-তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
গত ছয়মাস ধরে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জাতীয় প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করে, ট্রাম্প যে গণমানুষের মধ্যে আস্থা জাগাতে পারছেন না, তা সুস্পষ্ট উঠে আসে। তিনি যে জরুরি অবস্থার সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলি বুঝতে পারছেন; এমন ইঙ্গিতও তার কথায় মেলেনি।
ভাইরাস ছড়ানোর জন্য ট্রাম্প লাগাতার চীনকে দুষেছেন। দেশটির অপচেষ্টা রুখে দিতে তিনি যে চেষ্টা করেছেন, তার জন্য যথেষ্ট স্বীকৃতি পাচ্ছেন না; বলেও অভিযোগ করেন।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে অ্যাশলি ওয়েস্ট নামক এক ভোটার ট্রাম্পকে তার দায়িত্বপালন কালের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত কোনটি ছিল, তা উল্লেখ করার অনুরোধ করেন। ভাইরাসের তাণ্ডবে অচিরেই মার্কিন নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা যখন দুই লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রান্তে ছিল; ওই সময় এ প্রশ্নের জবাব দিতে ট্রাম্পকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়।
''আমি বুঝতে পারছি জীবন খুবই নাজুক অস্থায়ী ব্যাপার। আমার পরিচিত শক্তিশালী, প্রাণবন্ত এবং সরল অনেক মানুষ এতে (কোভিড-১৯) অসুস্থ হয়েছেন, অনেকেই মারা গেছেন। অন্তত ছয়জন আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। দুই সপ্তাহ আগেও এই সংখ্যা ছিল পাঁচজন যা এখন ছয়জনে পৌঁছেছে'' ট্রাম্প যোগ করেন।
- লেখক: সিএনএন পলিটিক্সের হোয়াইট হাউজ প্রতিনিধি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক
- অনুবাদ: নূর মাজিদ