ইরান-পাকিস্তান সংঘাত: বৈরিতার ঐতিহাসিক কারণ কী?

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আজ বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) ইরানে হামলা চালিয়েছে। তেহরান আগের দিন একই ধরনের হামলা চালানোর পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
দুই দেশই বলেছে, জঙ্গি আস্তানার বিরুদ্ধে এই হামলা চালানো হয়েছে।
পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ, অন্যদিকে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় বলে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, এই সংঘাত এমন দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনাকে উস্কে দিচ্ছে।
ইসরায়েল এবং ইরান সমর্থিত হামাসের মধ্যে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার সময়ে এই হামলা চালানো হয়েছে।
ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক বৈরিতা রয়েছে, তবে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তেহরানের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে এই সম্পর্কের কিছুটা উন্নতিও হয়।
তবে ক্ষমতা থেকে ইমরান খানকে অপসারণের পর, এবং সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় আসার পরে সেই ধারাবাহিকতা আর থাকেনি।
শত্রুরা একসময় মিত্র ছিল
ইরান ও পাকিস্তান সম্পর্ক স্থাপন করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিন। ইরান পাকিস্তানকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশ।
ইরানের রেজা শাহ পাহলভির সাথে ছিল পাকিস্তানের সুসম্পর্ক। এর অন্যতম কারণ ছিল উভয় দেশের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা এবং মধ্য এশিয়ায় সমাজতন্ত্র সম্প্রসারণ বিরোধী অবস্থান।
১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব পাহলভি রাজবংশকে উৎখাত করে, এরপর পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানকে স্বীকৃতি দিলেও শাহের আমলের মতোন সুসম্পর্ক আর থাকেনি। বরং, ইরানের নতুন সরকারের সাথে পাকিস্তানের চির বৈরী ভারতের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। একইসঙ্গে, পাকিস্তান ও ইরান একে-অন্যের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়, অন্তত শাহের পতনের আগে পর্যন্ত এই পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। দুই দেশই তখন কমিউনিস্ট বিরোধী জোট সিইএনটিও-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল।
একে-অন্যের পাশে দাঁড়ানো
১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে শাহের শাসনাধীন ইরান পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল।
উভয় দেশই বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এসময় দমন করেছে, এমনকি ১৯৭০-এর দশক বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান চালাতে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল ইরান।
মুজাহিদীনদের সমর্থন দেওয়া এবং তালেবানকে মোকাবিলা
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় (১৯৭৯-১৯৮৯) ইরান পাকিস্তানের অর্থায়নকৃত আফগান মুজাহিদিনদের সমর্থন দেয়। একইভাবে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় (১৯৮০-১৯৮৮) পাকিস্তান ইরানকে সমর্থন দেয়।
তৃতীয় আফগান গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৯২-১৯৯৬) তালেবানদের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন ইরানের জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, কারণ দেশটি সেই সময়ে তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের বিরোধী ছিল।
পরবর্তী চতুর্থ আফগান গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৯৬-২০০১) ইরান তালেবান-বিরোধী নর্দান এলায়েন্সকে সমর্থন দেয়। ৯/১১ হামলার পর পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়।
২০২০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তাঁদের সকল সেনা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়, এবং তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসে। এরপরে পাকিস্তান আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ইরানের সাথে সহযোগিতার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের পুরোধা ছিলেন ইমরানের খান। এসময় উভয় পক্ষই একমত হয় যে, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তাদের আফগানিস্তানকে ব্যবহার করা উচিত নয়।
অর্থ এবং মধ্যস্থতা
ইরান ও সৌদি আরবের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পাকিস্তান প্রায়ই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে।
ইরানও বৃহত্তর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
উভয় পক্ষই যেখানে সম্ভব সেখানেই অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে।
সীমান্তে উত্তেজনা
দুই দেশের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে কারণ বিভিন্ন জটিলতায় পরিপূর্ণ সীমান্তে প্রায়ই সংঘাত দেখা দিচ্ছে। উভয় দেশই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলিকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছে পরস্পরের বিরুদ্ধে।
২০২৪ সালের জানুয়ারির ঘটনাগুলি শুধু শুধু ঘটেনি। এগুলি বছরের পর বছর ধরে চলে আসা উত্তেজনা এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগের চূড়ান্ত পরিণতি যা সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইরান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইরানের মাটিতে হামলার জন্য দায়ী সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠী জাইশ আল-আদলকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এনেছে।
পাকিস্তান তার সীমান্তের মধ্যে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনের পালটা অভিযোগ দিয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে।
১৮ জানুয়ারির সংঘাত আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
ইরানের সীমান্ত শহর সারাভানের আশেপাশে দুটি স্থানে বিস্ফোরণে সাতজন অ-ইরানি নিহত হয়েছেন।
ইরান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী জইশ আল-আদলের বিরুদ্ধে ইরান হামলা চালানোর পরে পাকিস্তানের এই প্রতিক্রিয়া দেখায়।
ইসলামাবাদ জানিয়েছে, হামলায় দুই শিশু নিহত হওয়ার পাশাপাশি তিনজন আহত হয়েছে।
ইরানে পাকিস্তানি হামলায় তিন নারী ও চার শিশু নিহত হয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান প্রতিবেশীদের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর জন্য ১৭ জানুয়ারি তার পাকিস্তানি প্রতিপক্ষকে ফোন করেছিলেন, যদিও ইসলামাবাদ জোর দিয়েছিল যে তেহরানের "অবৈধ কাজ" এর প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে।
পাকিস্তান তেহরান থেকে তার দূতকে প্রত্যাহার করে এবং ইরানের রাষ্ট্রদূতকে ইসলামাবাদে ফিরে না যাওয়ার জন্য বলে- যা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।
জইশ আল-আদলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক একটি বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সুন্নি জঙ্গি গোষ্ঠীটি পাকিস্তানের সাথে প্রধানত শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সীমান্তে হামলা চালিয়ে আসছে।
এটি ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর একাধিক হামলা চালিয়েছে। সম্প্রতি ডিসেম্বরে একটি পুলিশ স্টেশনে হামলা করেছে যাতে ১১ জন নিহত হয়।
পাকিস্তান দ্বিতীয় দেশ যেটি তার ভূখণ্ডে ইরানের চালানো আক্রমণের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
এর আগে ইরাক ১৬ জানুয়ারি ইরাকি কুর্দিস্তানে কথিত ইসরায়েলি গুপ্তচর ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সমালোচনা করেছিল।
সীমান্তে শক্ত অবস্থান এবং ভূরাজনৈতিক জটিলতা
ভূ-রাজনীতি পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে।
পশ্চিমাদের সাথে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের সাথে কৌশলগত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। এর ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে মাঝে মাঝে দুই দেশের অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য দেখা গিয়েছে।
ইরান, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মধ্যে ত্রিভুজাকার মিথস্ক্রিয়া দ্বারা ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও চমকপ্রদ করে তুলেছে।
সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে সবসময়ই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু ইরান সৌদি আরবকে এই অঞ্চলে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে।
এটি পাকিস্তানকে একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে কারণ ইরানের সাথে বিরূপ সম্পর্ক তৈরি না করে দেশটি সৌদি আরবের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে।
আফগানিস্তানের সাথে সীমান্ত ভাগাভাগি করায় উভয় প্রতিবেশীর যে নিরাপত্তা সংকট বোধ করে, তা তালেবান শাসিত দেশটির সাথে পাকিস্তান ও ইরানের অস্থিতিশীল সম্পর্ক দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
কূটনৈতিক দক্ষতা এবং ভালো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
পর্দার পেছনের আরও গল্প
সামরিক কৌশল এবং কূটনৈতিক বিরোধের মধ্যে আরও সূক্ষ্ম আখ্যান এখানে উন্মোচিত হয়।
এই দ্বন্দ্ব যতটা অভ্যন্তরীণ লড়াই নিয়ে ঠিক ততটাই বাহ্যিক উত্তেজনা নিয়ে।
ইরান এবং পাকিস্তান উভয়ই তাদের নিজস্ব সংকটের সাথে লড়াই করছে। ইরান নিষেধাজ্ঞা এবং ঘরোয়া কলহের সাথে লড়াই করে তার শক্তি এবং প্রযুক্তিকে সবার সামনে দেখাতে চায়। পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার সাথে লড়াই করে তার কৌশলগত প্রাসঙ্গিকতাকে জাহির করার চেষ্টা করছে।
শক্তির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বর্তমান সংকটকে আরও জটিল করে তোলে।
রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরবের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভারসাম্যহীন করে যা আঞ্চলিক সমীকরণকে একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক দাবাবোর্ডে রূপান্তরিত করে।
তাই ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা বলা কঠিন।
ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে?
যদিও একটি সর্বাত্মক যুদ্ধকে আপাতত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে, আরও সংঘর্ষ বৃদ্ধির সম্ভাবনা এই অঞ্চলে অন্ধকার ছায়া ফেলেছে।
সামনে সুন্দরভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন সূক্ষ্ম কূটনীতি, আস্থা-নির্মাণের ব্যবস্থা এবং সংঘাতের মূল কারণগুলোকে মোকাবেলা করার সদিচ্ছা।