চট্টগ্রামে আশ্রয় কেন্দ্রে যায়নি এক লাখ ৩৬ হাজার মানুষ

ঘুর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে প্রাণহানী ঠেকাতে চট্টগামের দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় প্রশাসন দুই লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিলেও এখনো এক লাখ ৩৬ হাজার মানুষ আশ্রয় নেননি।
প্রশাসনিক তৎপরতার মধ্যেও আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে অনেকেই আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার দুপুর সোয়া দুইটা পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে গেছেন ৬৪ হাজার মানুষ।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। অনেকেই আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ১৭৭০টি। সব মিলিয়ে প্রস্তুত রয়েছে ৪০৪৬টি আশ্রয় কেন্দ্র।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে যেন প্রাণহানি না ঘটে, সেজন্য আমরা দুই লাখ লোককে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসার টার্গেট নিয়ে কাজ করছি। বুধবার দুপুর সোয়া দুইটা পর্যন্ত ৬৪ হাজার লোক আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছিলেন ৫৩ হাজার মানুষ।
সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করার পর উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে তৎপরতা শুরু করে প্রশাসন।
উপকূলীয় এলাকায় সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। খোলা হয়েছে লঙ্গরখানা। করোনা পরিস্থিতিতে বাড়ানো হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যাও।
সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বৌধি চাকমা বলেন, প্রথমে ১১০ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হলেও পরবর্তীকালে ১৬২টি প্রস্তুত করা হয়েছে। মঙ্গলবার ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়। বুধবার ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণার পর থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন জানান, উপজেলায় ১৬১টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। এরমধ্যে মঙ্গলবার রাতে ৪৫০ জন আশ্রয় নেন। ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা সাহেরখালী, ইছাখালী এবং ওসমানপুর ইউনিয়নে লঙ্গরখানা খোলা হচ্ছে। এখনো অনেকের ধারণা এই এলাকায় ঘূর্ণিঝড় এতটা ভয়াবহ হবে না। তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে আনা যাচ্ছে না। প্রশাসনিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। বুধবার রাতে তিন হাজার ৫০০ লোক আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারে বলে ধারণা করছি।
বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসনসূত্র জানায়, উপজেলায় ১০২টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা খানখানাবাদ, সাধনপুর, গান্ডামারা, ছনুয়া এলাকায় কিছু লোক আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করেছেন। আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, উপকূলীয় এলাকা কাট্টলী জেলেপাড়ার প্রায় ৩০০ জেলে পরিবার, পতেঙ্গা, ইপিজেড এলাকায় ২২০ পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নিচ্ছেন।
জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াছ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী উদ্ধার কাজে সহায়তার জন্য উদ্ধারকারী দল প্রস্তুত রয়েছে। জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবকরা একযোগে কাজ করছেন।
রোজগারের সম্বল হারানোর ভয়ে আশ্রয় কেন্দ্র যাচ্ছেন না অনেকে।

বুধবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইসমাইল সুকানি প্রাথমিক বিদ্যালয় গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয় কেন্দ্রটি জনশূন্য। কিছু মালামাল দেখা গেলেও কাউকে সেখানে পাওয়া যায়নি। সুপার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আসন্ন আঘাত থেকে জানমাল রক্ষায় উপকূলবাসীকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হলেও বেশিরভাগই কানে নিচ্ছেন না। তারা ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবিলায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত দুদিন ধরে উপকূল এলাকায় মাইকিং করছে। কিন্তু বেশিরভাগ উপকূলবাসী মাইকিং পাত্তা দিচ্ছেন না। এরমধ্যে মঙ্গলবার অভিযান চালিয়ে উপকূলীয় এলাকার শত শত পরিবারকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হলেও অনেক পরিবার ইতোমধ্যে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়েছেন। উপকূলীয় এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো ঘুরে এসব চিত্র চোখে পড়েছে।
বুধবার দুপুরে কথা হয় পতেঙ্গা বেড়িবাঁধ সড়কের জেলেপাড়া এলাকার বাসিন্দা হরি জলদাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় আমাদের সবকিছু কেড়ে নেয়। ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলে। তবে বাড়িতে মাছ ধরার জালসহ নানা সরঞ্জাম রয়েছে। এগুলো আমাদের রোজগারের সম্বল। এ ছাড়া এসব সরঞ্জাম নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া যাবে না; তাছাড়া চুরি হওয়ার ভয় রয়েছে। তাই প্রয়োজনে সারা রাত না ঘুমিয়ে বসে থাকব। তবু আশ্রয় কেন্দ্রে যাব না।
উপকূলবাসী জানিয়েছেন, তাদের ঘরে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র রয়েছে। সেগুলো ফেলে আশ্রয় কেন্দ্রে গেলে সব চুরি হয়ে যাবে। এর আগে এই ধরনের দুর্যোগে চোরেরা সবকিছু নিয়ে গিয়েছিল। তাই আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছে না তারা।