জ্বালানি আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ২ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হবে

জ্বালানি আমদানির জন্য ২ বিলিয়ন ডলার দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করবেন বলে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বুধবার (২৬ অক্টোবর) সরকারের নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত সভায় তারা এ আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সভায় উপস্থিত সূত্র।
এছাড়া বাড়তি ফার্নেস তেল আমদানির জন্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের এলসি সীমা বাড়ানোর জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করবেন তারা।
এ লক্ষ্যে আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে বৈঠক করবেন নসরুল হামিদ ও সালমান এফ রহমান।
সভায় প্রতিমন্ত্রী সালমান এফ রহমানকে বলেন, 'এই সংকটকালে আমরা যদি ব্যবসায়ীদের সাহায্য করতে না পারি, তাহলে রিজার্ভের ৩৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে আমরা কী করব? আপনি তাদের [শিল্প] জন্য ২ বিলিয়ন ডলার আলাদা করে রাখুন, বাকিটা আমাকে সামলাতে দিন।'
সভা সূত্র জানিয়েছে, নসরুল হামিদ বলেছেন, শিল্পের জন্য জ্বালানি আমদানিতে ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হলে তা রপ্তানি আয়ের আকারে ৪ বিলিয়ন ডলার হয়ে ফিরে আসবে।
ঝুঁকিতে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, 'শিল্পের জন্য যদি প্রয়োজনীয় জ্বালানি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমাদের রিজার্ভে ৩৬ বিলিয়ন ডলার রাখার কোনো মানে নেই। এভাবে সরবরাহ সংকট চলতে থাকলে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে।'
ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী নেতাদের একটি দল বৈঠকে অংশ নেন।
বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো যখন রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও সিরামিক প্রস্তুতকারকরা চলমান জ্বালানি সংকটের সময় শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের কাছে মরিয়া হয়ে পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুত সরবরাহের দাবি জানিয়ে আসছেন।
'যেকোনো মূল্যে জ্বালানি আমদানি করতে হবে'
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শিল্প চালু রাখতে হলে যেকোনো মূল্যে জ্বালানি আমদানি করতে হবে। শুধু জ্বালানি আমদানি বন্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না, কারণ আমাদের বাড়তি ২০০ মিলিয়ন খরচ করতে হবে।'
উৎপাদন খাতে বাড়তি ২০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা তেমন বড় বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনও ৩৬ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে যদি এটুকু টাকা খরচ করা না যায়, তাহলে রিজার্ভের কার্যকারিতা কী?'
সালেহউদ্দিন বলেন, উৎপাদন কমে গেলে রপ্তানি আয়ও কমবে। ফলে রিজার্ভ বাড়ানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। আবার উৎপাদন কমায় খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের আমদানি বেড়ে যাবে, ফলে রিজার্ভ আরও কমবে।
বুধবারের বৈঠকে প্রতিমন্ত্রী বলেন, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার জন্য তারা কাতার, ব্রুনাই ও ওমানের মতো বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শুধু কাতার এই গ্যাস সরবরাহ করতে রাজি হয়েছে।
ফার্নেস-তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ সস্তা বিকল্প
ক্রমবর্ধমান গ্যাস সংকটের মধ্যে ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথাও ভাবছে সরকার। চড়া খরচে ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করেন নসরুল হামিদ।
'তাই আমরা ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছি—যা সস্তা বিকল্প হবে,' বলেন তিনি।
ফার্নেস তেলভিত্তিক কেন্দ্রে থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ হয় ১৭ টাকা, ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রে ব্যয় ৩৭ টাকা এবং গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে ব্যয় হয় ৩ টাকা থেকে ৩.৫ টাকা।
নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) যেন ফার্নেস তেল আমদানি করতে পারে, সেজন্য তাদের এলসি সীমা বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলবে সরকার।
সভায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ডলারের চড়া মূল্য ও বিশ্বব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানির দাম বেড়েছে।
প্রতিমন্ত্রী ব্যবসায়ী নেতাদের পরামর্শ দেন, তারা যেন বিদ্যমান শতাংশ হারে শুল্ক-কর আদায়ের পরিবর্তে জ্বালানি আমদানির ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর ও শুল্ক আদায় করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ করেন।
বিডায় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে সভা শেষে নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'পরিস্থিতির যেন আরও অবনতি না হয়, সে লক্ষ্যে আমরা গ্যাস সরবরাহ সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেব।'
নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ পাওয়া যাচ্ছে না, এমন অভিযোগ ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা তার কাছে করেছেন বলে উল্লেখ করেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমরা এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে, সমাধানের চেষ্টা করব।'
গ্যাস আমদানি ব্যয় ডলার বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধের বিষয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, 'বিষয়টি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নির্ভর করে না।'
'এটি সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাস পাওয়ার বিষয়। কিন্তু বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। আমরা যদি চড়া দামে [গ্যাস] কিনি, তবে তা সরবরাহও করতে হবে চড়া দামেই,' সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
গ্যাস সরবরাহ গত বছরের মতোই রয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলগুলোতে গ্যাসের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান সালমান এফ রহমান।
এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ী নেতারা শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছেন।
'এ নিয়ে আমরা আরও আলোচনা করব। সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করব,' বলেন তিনি।