আর্থিক উন্নয়নের সঠিক পথ নিরূপনেও প্রয়োজন বিতর্কহীন নির্বাচন

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত আসার আগে ভারতবর্ষ থেকে স্বাধীন হওয়া তিনটি দেশের ভূখণ্ডে মোট কতজন রাজা শাসন করত তার সঠিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতকে একক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। তারপর সেই ১৯৪৭ সালে ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তি। পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় আজকের বাংলাদেশ। তিনটি দেশের মধ্যে পাকিস্তান এবং ভারত তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে বলা যায়।
সাম্প্রতিককালে ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খানের দল তাঁর দেশের আটটি উপনির্বাচনের ছয়টিতেই জয়লাভ করেছেন। ইমরান খানের দল বাদবাকি দুটি আসনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তুলেনি।
ভারতের ইভিএম নিয়ে নানান বিতর্কের পরে বিজেপির শাসন আমলেই ইভিএম কার্যকর করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত রাজ্য পশ্চিমবাংলায়ও ইভিএম ভিত্তিক নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো শোরগোল হয়নি। ক্ষমতাসীন তৃণমূল যেহেতু জয়লাভ করেছে সেই কারণে কিনা! তবে কোনো বিতর্ক হয়নি বলা যায়।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য রাজনীতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি এই রাজ্যে পরাজিত হয়েছে। তারাও সেই ইভিএম এর ব্যবস্থা নিয়ে তেমন কোনো বিরূপ মন্তব্য করেনি। তবে ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবাংলা ও উত্তর প্রদেশ রাজ্য দুটি বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে আছে। নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যকরের এমনই একটি সূচকে পশ্চিমবাংলা পেছনে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু সামাজিক সূচকেও এই রাজ্য দুটি ভারতের অন্যান্য অনেক রাজ্য থেকে পিছিয়ে আছে।
ভারতের রাষ্ট্র হিসেবে বেড়ে ওঠা এবং ভারতীয় সমাজের নানান মারাত্মক সব সামাজিক বিধি-বিধান এই কলকাতা কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমেই পরিবর্তন করা হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করা, বিধবা বিবাহ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। প্রথম উচ্চ আদালত হাইকোর্ট গঠন, প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়- সবই বর্তমান পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতাতেই গড়ে উঠেছিল।
ভারতের ইভিএম ব্যবস্থার বিতর্কের অবসানে তাদের নির্বাচন কমিশন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে ইভিএম বিতর্ক থামে। ইভিএম এখন নির্বাচন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ইভিএম মেশিনের কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল যার ফলে এই বিতর্কের অবসান হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল ভোটারের ভোট প্রদান করার পরে সে কোন দলে ভোট দিল, কোন প্রতীকে ভোট দিল, তা সে নিজেই প্রত্যক্ষ করতে পারবে, যা একটি কাগজ হিসাবে ভোট বাক্সে জমা হবে। যা প্রয়োজনে আবার পুনঃগণনার সময় ব্যবহার করা যাবে। এমনি একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি সংযুক্ত হওয়াতে ইভিএম বিতর্ক থেমে গেছে ভারতে।
ভারতের ইভিএম ক্রয় মূল্য নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। যা আমাদের দেশে বর্তমানে চলছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে বিতর্ক তা এই ভূখণ্ডে অনাদিকাল থেকে চলছে। প্রথম নির্বাচনের স্বাদ পেয়েছিল এই ভূখণ্ডের কিছু মানুষ সেই ১৯৩৭ সালের ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে। তখন সার্বজনীন ভোটের অধিকার ছিল না। আবার নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না। এর পরের নির্বাচন যেগুলো ব্রিটিশ ভারতে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেসব নির্বাচনে বিতর্ক ছিল না। পাকিস্তানের জন্মের পরে প্রথম নির্বাচন ১৯৫৪ সালে। সেই নির্বাচন থেকেই এদেশের নির্বাচনী বিতর্ক শুরু যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের দিকে যাত্রা করেনি। তারা বিতর্কহীন নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্যও চেষ্টা করেনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা পুনরায় প্রত্যাবর্তন করেন। সেই হ্যাঁ/না ভোটে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট জিয়াউর রহমানের পক্ষে পড়েছিল বলে জানানো হয়। এরপর ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়েছে বলে স্বীকৃতি পায়নি। এমন ঘটেছে এরশাদের শাসনামলেও। ১৯৮৬ সালের এরশাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, তারপর ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন এবং শেষে ১৯৮৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তদানীন্তন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বর্জন করা সত্ত্বেও সেই নির্বাচন বাতিল হয়নি।
এরপর দেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র ফেরত নিয়ে আসার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালে। সেই সময় সে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রধান জোটগুলো আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ছিল। তারা নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। এরশাদের জাতীয় পার্টি নির্বাচনকালীন সময়ের বিচারপতি শাহাবুদ্দিন সাহেবের সরকার ও নির্বাচন কমিশন তাদের সঙ্গে নিরপেক্ষ ব্যবহার করেননি এই অভিযোগ তুলেছিল। পরের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন করার ইতিহাস। এই বিতর্কের ফলেই সমাজের সামাজিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রা তার গতি লাভ করেনি।
বিগত দুইটি সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন যা এই মুহূর্তে দেশে সবচেয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সক্রিয় শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাবে উন্নয়নের নানান বিষয় নিয়ে আমাদের সংসদে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা না হওয়াতে যে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তা দেশের জন্য মারাত্মক সংকট ডেকে এনেছে।
নির্বাচন কেবলমাত্র সামাজিক উন্নয়ন নয়, আর্থিক উন্নয়নের সঠিক পথ নিরূপণের জন্যও প্রয়োজন। দেশে কার্যকর বিরোধী দল না থাকার ফলে রাষ্ট্র এখন এই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক বিভাজনের ফলে জ্বালানি খাতের উন্নয়নের জন্য নিজস্ব জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে নজর দেওয়া যায়নি। দেশে ৩০০ কোটি টন কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও দেশে আমদানি নির্ভর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
দেশ আবার একটি নির্বাচনের দিকে হাঁটছে। আগামী বছরের আসন্ন নির্বাচনী বিতর্ক জোরদার হচ্ছে ক্রমশ। কোভিড উত্তর পরিস্থিতি এবং ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্বকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে গভীরভাবে ঠেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নানান পরামর্শ এক্ষেত্রে সামনে আসছে। খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন তখন পাশাপাশি দু-একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অব্যাহতভাবে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টির পরিবর্তে বিভাজনের রাস্তায় হাঁটছেন।
গণমাধ্যমে এমন সব কথা উঠে আসছে যা থেকে স্পষ্ট হয় যে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের মাটি আরো উত্তপ্ত করা হবে। সাম্প্রতিক কালের দু-একটি রাজনৈতিক সমাবেশ তেমনি সংকেত দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্বিগ্নতা, মন্ত্রিসভার সে সমস্ত মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ আক্রমণাত্মক বক্তব্য সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।
গাইবান্ধা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের নির্বাচন কমিশন এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এই নির্বাচন বাতিল হওয়া কোনো সাধুবাদ পায়নি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে সোচ্চার হওয়ার ফলে মানুষ মনে করছে এই বিষয়টি একটি সাজানো বিষয়। এক পর্যায়ে শোনা যাচ্ছিল ৯৮টি নির্বাচন কেন্দ্র থেকে সঠিক পথে নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে বলেই তথ্য পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমে এমনই উল্লেখ করা হয়েছিল। তারপরেও সেই নির্বাচন বাতিল হওয়া এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানান বক্তব্যের কোনোটাই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি।
দেশের জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং প্রায় বিরোধী দলবিহীন সেই নির্বাচনে সরকারি দল বেশ কিছু আসন হারিয়েছে। প্রকাশ্যেই আলোচনা হচ্ছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টাকা লেনদেনের। দেশ যখন রাজনৈতিকভাবে বিবাজিত হয় সুশাসনের পথে চলতে ব্যর্থ হয় তখন পর্দার অন্তরালের শক্তি তাদের শক্তি অর্জন করে। বারবার ইতিহাসের পাতা খুঁজলে তাই দেখা যায়। একসময় পাকিস্তানের বিভাজিত সমাজে বিচার বিভাগকে যেমন কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল, সুশাসন বিহীন সমাজ তেমনি সব অবস্থার সৃষ্টি হয়। সবকিছু বিবেচনায় রেখেই আগামী দিনগুলো মোকাবেলা করতে হবে সম্মিলিতভাবে।