বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পর্যটক টানছে ব্যাংকক, কিন্তু তাদের ‘বেপরোয়া’ আচরণে অতিষ্ঠ এশিয়া
মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতার কথা ভুলে যান। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এই সপ্তাহের 'মিস ইউনিভার্স' হলো প্যারিস। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় টানা পঞ্চমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহরের স্বীকৃতি পেয়েছে ফ্রান্সের রাজধানী।
পর্যটন, টেকসই পরিবেশ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের ১০০টি শহরের এই তালিকা তৈরি করেছে ডেটা অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর।
যদিও প্যারিসের এই জনপ্রিয়তার চড়া মূল্য দিতে হবে পর্যটকদের, বিশেষ করে যারা ইউরোপের বাইরে থেকে যাবেন। নতুন বছর থেকে প্যারিসের বিখ্যাত ল্যুভর মিউজিয়ামে প্রবেশের টিকিটের দাম ৪৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এই বাড়তি খরচ গুনতে হবে কেবল ইউরোপিয়ান ইকোনমিক এরিয়ার বাইরের দর্শনার্থীদের।
তবে সেরা শহরের তকমা প্যারিসের হলেও পর্যটকদের ভিড় সবচেয়ে বেশি ব্যাংককে। ইউরোমনিটরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানীতে ৩ কোটি ৩ লাখ বিদেশি পর্যটক পা রাখবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহরের তালিকায় তাই শীর্ষেই থাকছে ব্যাংকক।
সামগ্রিকভাবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে পর্যটকদের আনাগোনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক পর্যটক বেড়েছে ১০ শতাংশ। তবে পর্যটকদের অসদাচরণ এবং বিশৃঙ্খলা এই অঞ্চলের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নতুন সংকট তৈরি করছে।
ঐতিহাসিক শহরগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সমুদ্রসৈকতে বালুর চেয়ে পর্যটকদের তোয়ালে আর ছাতার সংখ্যাই যেন বেশি। এর সঙ্গে আছে মাতলামি আর বিশৃঙ্খল আচরণের জেরে পর্যটকদের গ্রেপ্তারের ঘটনা।
শুনে মনে হতে পারে, এটা বুঝি ইউরোপের বার্সেলোনা বা ভেনিসের চিত্র। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা তো রীতিমতো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু না, এই চিত্র এখন এশিয়ারও।
ইউরোপের মতো এশিয়ার জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোও এখন পর্যটকের ভারে ধুঁকছে। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে একদিকে যেমন স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সেই জৌলুশ, যার টানে মানুষ সেখানে ছুটে যান।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক ভ্রমণ বিশ্লেষক সিএনএনকে বলেন, 'পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বোতল থেকে যেন দৈত্য বেরিয়ে এসেছে। এখন একে কীভাবে আবার বোতলে ভরা যাবে, সেটাই প্রশ্ন।'
তবে সমস্যাটা আসলে জায়গার অভাব নয়। এশিয়া বিশাল একটি মহাদেশ, এখানে দেখার মতো জায়গার শেষ নেই। অনেক অঞ্চল তো পর্যটকের অভাবে ধুঁকছে, সেখানকার অর্থনীতি বাঁচাতে পর্যটক খুব দরকার। আসল সমস্যা হলো, সবাই মিলে নির্দিষ্ট কিছু জায়গাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে এই উপচে পড়া ভিড়ের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। মহামারির পর মানুষের মধ্যে জমে থাকা ভ্রমণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এশিয়ার বিভিন্ন গন্তব্যে বিমানের সস্তা টিকিট এবং ভারত ও চীনের মতো জনবহুল দেশগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভ্রমণের আগ্রহ বৃদ্ধি—সব মিলিয়েই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পর্যটন বোর্ডগুলোর লোভনীয় সব প্রচারণা।
পাশাপাশি এখন বিদেশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের দেশ ঘুরে দেখার প্রবণতাও বেড়েছে স্থানীয় পর্যটকদের মধ্যে।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পিএটিএ) তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, মহামারি-পরবর্তী সময়ে এশিয়ায় পর্যটন খাত দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের সাম্প্রতিক অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় (চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া) পর্যটন প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০ শতাংশ। এমনকি মঙ্গোলিয়ার মতো দুর্গম গন্তব্যেও পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে।
অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পর্যটনের ভর মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ভিয়েতনামে পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার (ইউএনডাব্লিউটিও) তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভিয়েতনামে বিদেশি পর্যটকের আগমন বেড়েছে ২১ শতাংশ।
এদিকে জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম শহরের তকমা হারিয়েছে টোকিও। ২০১৮ সাল থেকে এই মুকুট জাপানের রাজধানীর দখলেই ছিল। টোকিওকে হটিয়ে জনসংখ্যার বিচারে শীর্ষস্থান দখল করেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি রাজধানী।
অন্যদিকে, দুবাই মানেই যেন রেকর্ডের ছড়াছড়ি। গগনচুম্বী সব অট্টালিকা দিয়ে সাজানো এই শহরে চালু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু হোটেল।
দুবাইয়ে সদ্য চালু হওয়া 'সিয়্যাল দুবাই মারিনা' এখন বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু হোটেল। ৩৭৭ মিটার (১ হাজার ২৩৭ ফুট) উঁচু এই ভবনটি যেন মেঘ ছুঁতে চায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, নির্মাতারা জানান, শুরুতে তারা ভাবেননি এটি এত উঁচু হবে।
স্থপতি ইয়াহিয়া জান জানান, যে জমির ওপর হোটেলটি দাঁড়িয়ে, তার আয়তন একটি ফুটবল মাঠের চেয়েও কম। জায়গার এত টানাটানি ছিল যে, ভবনটিকে ওপরের দিকে তোলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। নকশা করার সময় তাই কৌশলী হতে হয়েছে তাঁদের।
তবে রেকর্ডের দৌড়ে শুধু দুবাই নয়, পাল্লা দিচ্ছে নরওয়ে, চীন ও ভারতও। কোথাও তৈরি হচ্ছে সাগরের তলদেশে দীর্ঘতম সুড়ঙ্গ, আবার কোথাও মেঘ ফুঁড়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সেতু।
উচ্চতায় দুবাই এগিয়ে থাকলেও সেবার মানে ও আভিজাত্যে ২০২৫ সালের বিশ্বের সেরা হোটেলের খেতাব জিতেছে হংকংয়ের 'রোজউড'। হসপিটালিটি ব্র্যান্ড 'ফিফটি বেস্ট'-এর তালিকায় এটি শীর্ষে। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে ব্যাংককের চাও ফ্রায়া নদীর তীরের 'ফোর সিজনস ব্যাংকক'।
মাটির ওপর থেকে এবার যাওয়া যাক সাগরের তলদেশে। নরওয়ে তৈরি করছে বিশ্বের দীর্ঘতম ও গভীরতম সমুদ্রতলদেশের রেল টানেল। ১৭ মাইল দীর্ঘ এই 'রোগফাস্ট' টানেল চালু হলে ফেরি পারাপারের ঝামেলা কমবে, বাঁচবে যাতায়াতের সময়।
অন্যদিকে চীনও পিছিয়ে নেই। গত সেপ্টেম্বরে দেশটির গুইঝাউ প্রদেশে চালু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সেতু 'হুয়াজিয়াং গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ব্রিজ'। নদী থেকে ২ হাজার ৫১ ফুট উঁচুতে মেঘের রাজ্য ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে এই সেতু।
এদিকে, ভারতের কাশ্মীর অঞ্চলেও গত জুনে চালু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলসেতু। ১ হাজার ১৮০ ফুট উঁচু এই 'চেনাব ব্রিজ' প্রথমবারের মতো রেলপথে কাশ্মীরকে ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে যুক্ত করেছে। চেনাব নদীর ওপর ধনুকের মতো বাঁকানো এই সেতুটি স্থাপত্যবিদ্যার এক অনন্য নিদর্শন।
