বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারের জ্ঞান যেভাবে সাম্রাজ্যের পতন সত্ত্বেও টিকে রইল
ব্রিটিশ মিউজিয়াম যথার্থভাবেই আশুরবানিপালের গ্রন্থাগারের আবিষ্কারকে "সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ" প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হিসেবে বর্ণনা করে। কারণ অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য সম্পর্কে আজ আমরা যা জানি, তার অধিকাংশের উৎস এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত প্রায় ৩০ হাজার কিউনিফর্ম লিপির ট্যাবলেট বা মাটির ফলক।
অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য মানবসভ্যতার অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্ব ১৪শ শতকের কোনো একসময় বর্তমান ইরাকের এক নগররাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে এর বিকাশ ঘটে। সাম্রাজ্যের শীর্ষ সময়ে এর বিস্তৃতি মিশরের নীল নদের বদ্বীপ থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পরে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে ব্যাবিলনীয় ও মিডিয়ানদের হাতে রাজধানী নিনেভের পতনের মধ্য দিয়ে এই সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
গ্রন্থাগারটির নামই জানিয়ে দেয় যে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আশুরবানিপাল—যিনি ৬৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। অন্যান্য অ্যাসিরীয় রাজার তুলনায় আশুরবানিপাল যুদ্ধের চেয়ে জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর শাসনামলের খোদাইচিত্রে প্রায়ই তাঁকে স্টাইলাস হাতে দেখা যায়, এবং গ্রন্থাগারে পাওয়া বহু ট্যাবলেটে রয়েছে তাঁর রাজকীয় সীলমোহর। ধারণা করা হয়, নিনেভের রাজপ্রাসাদের ভেতরেই এসব লেখনী সংরক্ষিত ছিল।
প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে আশুরবানিপালের এই গ্রন্থাগারের মর্যাদা ছিল বর্তমানে আমাদের কাছে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের মতো—একটি হারিয়ে যাওয়া, কিংবদন্তিতুল্য জ্ঞানভাণ্ডার। এই সম্রাট জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত নানা বিষয়ে তিনি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। উনিশ শতকে গ্রন্থাগারটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর গবেষকেরা সেখানে অভিধান, ঐতিহাসিক নথি, প্রার্থনা-বিষয়ক লেখাসহ বহু ধরনের ট্যাবলেট খুঁজে পান। এর মধ্যে রয়েছে গিলগামেশ মহাকাব্যের একটি অনুবাদও—সুমেরীয় রাজা গিলগামেশের সে কাহিনি, যেখানে তিনি দানব বধ করেন এবং অমরত্বের সন্ধানে ব্যর্থ অভিযানে বের হন।
এদের অনেক লেখাই টিকে আছে ধ্বংসের মধ্য দিয়েই। যখন মিডিয়ান ও ব্যাবিলনীয়রা নিনেভে আক্রমণ চালায়, তারা নগরীসহ গ্রন্থাগারেও আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে পার্চমেন্ট ও প্যাপিরাসের সংগ্রহ ছাই হয়ে গেলেও কাদামাটির ট্যাবলেটগুলো রক্ষা পায়। আগুনের তাপে এগুলো দ্বিতীয়বারের মতো পুড়ে আরও শক্ত হয়ে যায়, এমনকি ভবনটি যখন ধসে পড়ে তখন ধ্বংসস্তূপের চাপও তারা সহ্য করে টিকে যায়।
বিস্ময়ের বিষয়—এই গ্রন্থাগারের মাধ্যমে অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্য সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বিপ্লব ঘটালেও, গ্রন্থাগারটির মূল স্থাপনা সম্পর্কে এখনো খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। নিনেভে ও আশপাশের এলাকায়—যা আজকের ইরাকের মসুল নগরীর কাছে—খননকাজ ২০১৪ সালে আইএস দখলদারিত্ব শুরু হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে আইএস পরাজিত হওয়ার পর কার্যক্রম পুনরায় শুরু হলেও অঞ্চলের অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভবিষ্যৎ গবেষণাকে ঝুঁকির মুখে রেখেছে।
তবুও আসিরিওলজি বা অ্যাসিরীয় ইতিহাসচর্চা এগিয়ে চলেছে। চলতি বছর নিনেভেতে খননকার্যে নতুন করে বেশ কয়েকটি কিউনিফর্ম ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে, যেখানে আশুরবানিপালসহ অন্যান্য শাসকের শিলালিপি রয়েছে। সঙ্গে পাওয়া গেছে সিরিয়া থেকে আসা নানা সামগ্রী—যেগুলো সম্ভবত কোনো সামরিক অভিযানে দখল হয়ে অ্যাসিরিয়ায় আনা হয়েছিল। আরও আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষের মাথাওয়ালা ডানা-ওয়ালা বিশাল ষাঁড়ের একটি ২০ ফুট উচ্চতার মূর্তি—অ্যাসিরীয় শিল্পের বহুল ব্যবহৃত প্রতীক, এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় নমুনা।
এদিকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে আশুরবানিপাল লাইব্রেরি প্রজেক্টের নেতৃত্বে এখন রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের কিউরেটর জন টেলর, যিনি আগে দায়িত্বে থাকা ভাষাতত্ত্ববিদ ও ইন্টারনেটখ্যাত ব্যক্তিত্ব আরভিং ফিঙ্কেলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। গ্রন্থাগারের সংগ্রহ সংরক্ষণ, গবেষণা ও ডিজিটাইজেশনের এই প্রকল্পে ২০২০ সাল থেকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসাবিদ্যা সম্পর্কিত ট্যাবলেটগুলোতে। একই সঙ্গে তাঁরা স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করছেন গ্রন্থাগারটি কীভাবে এবং কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—এ সম্পর্কেও নতুন তথ্য খুঁজে বের করতে।
