রোবোট্যাক্সি প্রতিযোগিতায় চীন কেন অন্যদের চেয়ে এগিয়ে?
চীনের পনি ডট এআইয়ের রোবোট্যাক্সিতে চড়লে অভিজ্ঞতা অনেকটা সাধারণ ট্যাক্সির মতোই মনে হতে পারে। হরদম হর্ন বাজছে, যেমনটা আমরা গাড়িতে শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু একবার চালকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, চালকের আসন একদম ফাঁকা, আর গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল ঘুরছে নিজে নিজেই! সামনের স্ক্রিনে শুধু ভেসে উঠছে আশপাশের গাড়ির অবস্থান। এই দৃশ্যই বলে দিচ্ছে, চালকবিহীন বা স্বয়ংক্রিয় ট্যাক্সির দৌড়ে চীন এখন কতটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রোবোট্যাক্সি সেবা চালু করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিসরে কাজ করছে 'অ্যাপোলো গো'। চীনের প্রযুক্তি জায়ান্ট বাইডুর মালিকানাধীন এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে এক হাজারের বেশি চালকবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলছে। তাদের লক্ষ্য, ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ২০ হাজার গাড়ি নামানো।
এছাড়া, পনি ডট এআই চারটি শহরে এবং উইরাইড তিনটি শহরে তাদের সেবা চালু করেছে। চীনা গাড়ি নির্মাতা জিলির রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান 'কাওকাও মোবিলিটি' দুটি শহরে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। পাশাপাশি বড় ইকোসিস্টেম তৈরি হচ্ছে; অটোনোমাস সফটওয়্যার স্টার্টআপ 'মোমেন্টা' রাষ্ট্রায়ত্ত গাড়ি নির্মাতা এসএআইসির সঙ্গে রোবোট্যাক্সি তৈরি করছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা এক্সপেংও জানিয়েছে, আগামী বছরই তারা পুরোদমে রোবোট্যাক্সি উৎপাদন শুরু করবে।সব মিলিয়ে, চীনের রোবোট্যাক্সি শিল্প এখন বড় ধরনের বাণিজ্যিক সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বর্তমানে এই খাতের আয় ৫০ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে ২০৩৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। তখন চীনে প্রায় ১৯ লাখ রোবোট্যাক্সি চলাচল করবে, যা দেশটির মোট রাইড শেয়ারিং গাড়ির ২৫ শতাংশ হবে।
আরেক বিনিয়োগ ব্যাংক ইউবিএস আরও আশাবাদী। তাদের ধারণা, ২০৩০-এর দশকের শেষ নাগাদ এই বাজারের আকার ১৮০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
কোনো কোনো মানদণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের রোবোট্যাক্সি শিল্পকে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে চীন। দেশটির ৫০টির বেশি শহরে এখন জনাকীর্ণ রাস্তায় চালকবিহীন গাড়ি বা স্বয়ংক্রিয় গাড়ি পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি শহরে বাণিজ্যিকভাবেই চলছে রোবোট্যাক্সি।
চীনে রোবোট্যাক্সির সম্ভাবনাও বিশাল। তবে রোবোট্যাক্সি শিল্পে চীন যে বড় পরিসরে সফল হবে, তা বিশ্বাস করার মতো বেশ কিছু কারণও রয়েছে।
চীনের এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ সরকারি সমর্থন। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার প্রযুক্তিতে নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছে। একই সঙ্গে স্থানীয় সরকারগুলোও বিনিয়োগ টানতে আগ্রহী। তারা দ্রুতগতিতে রোবোট্যাক্সি নামানোর অনুমোদন দিচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করছে।
উদাহরণ হিসেবে পূর্ব চীনের উসি শহরের কথা বলা যায়। সেখানে ১ হাজার ৭২৩টি মোড়ের ট্রাফিক লাইটগুলোকে 'ইন্টেলিজেন্ট' নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া রোবোট্যাক্সি চলাচল সহজ করতে শহরের ৩৩০টি স্থানে বিশেষ সেন্সর বসানো হয়েছে।
চীনের স্বয়ংক্রিয় গাড়িগুলো তুলনামূলক সস্তা। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রোবোট্যাক্সি কোম্পানি 'ওয়েমো'র বর্তমান প্রজন্মের একেকটি গাড়ি তৈরিতে খরচ হয় ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ ডলার। এসব গাড়িতে প্রচুর সেন্সর ও শক্তিশালী কম্পিউটিং ব্যবস্থা থাকে। অন্যদিকে এইচএসবিসি ব্যাংকের তথ্যমতে, চীনে একটি রোবোট্যাক্সি তৈরিতে গড়ে খরচ হয় মাত্র ৪০ হাজার ডলার।
আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান বাইডু ও রাষ্ট্রায়ত্ত গাড়ি নির্মাতা জিয়াংলিংয়ের তৈরি 'আরটি৬' মডেলের রোবোট্যাক্সির দাম তো আরও কম—মাত্র ৩৫ হাজার ডলার। মূলত চীনে বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার এবং তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে গাড়ির দাম কমে এসেছে।
স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চলাচলের জন্য লাইডার (লেজারভিত্তিক রাডার, যা গাড়ির আশপাশে থ্রি–ডি ছবি তৈরি করে) প্রযুক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্পমূল্যের গাড়িতেও এখন স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম ব্যবহৃত হওয়ায় এসব সেন্সরের দাম কমেছে। বিশ্ববাজারে লাইডারের ৯০ শতাংশই এখন 'হেসাই'সহ চারটি চীনা কোম্পানির দখলে।
গাড়ি তৈরির খরচ কম হলেও চীনের রোবোট্যাক্সি কোম্পানিগুলো এখনো লাভের মুখ দেখেনি। এর অন্যতম কারণ, চীনে সাধারণ ট্যাক্সিচালকদের মজুরি বেশ কম; ফলে ভাড়ার হারও সস্তা।
বাজারের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান 'অ্যাপোলো গো' দাবি করেছিল, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ তাদের আয় ও ব্যয় সমান হবে (ব্রেক ইভেনে পৌঁছাবে) এবং চলতি বছর থেকেই তারা মুনাফা করবে। কিন্তু সেই সময়সীমা পার হওয়ার পর এখন তারা নিশ্চুপ। অন্য দুই প্রতিষ্ঠান 'উইরাইড' ও 'পনি ডট এআই' মুনাফা থেকে এখনো বহু দূরে। সম্প্রতি হংকং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠান দুটির শেয়ারের ব্যাপক দরপতনই বলে দিচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা খুব সহসা লাভের আশা করছেন না।
গোল্ডম্যান স্যাকসের পূর্বাভাস বলছে, চীনের বড় শহরগুলোতে রোবোট্যাক্সি পরিচালন মুনাফায় আসতে ২০৩২ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আর ছোট শহরগুলোতে লোকসান গুনতে হতে পারে আরও বহুদিন।
গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানোও চীনের কোম্পানিগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাইড শেয়ারিং জায়ান্ট উবার তাদের বিশাল গ্রাহকভিত্তি বিভিন্ন রোবোট্যাক্সি কোম্পানির জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
কিন্তু চীনে রাইড শেয়ারিং বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশই 'ডিডি'র দখলে। ডিডি নিজেই যেহেতু রোবোট্যাক্সি নিয়ে কাজ করছে, তাই তারা প্রতিযোগীদের জন্য নিজেদের প্ল্যাটফর্ম খুলে দিতে নারাজ। ফলে অন্য কোম্পানিগুলোকে হয় নিজস্ব অ্যাপ তৈরি করতে হচ্ছে, নয়তো ছোট ছোট রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে হচ্ছে।
জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চীনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখন কিছুটা ধীরলয়ে এগোচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চালানোর ওপর বিভিন্ন জেলা ও প্রদেশে ৭০টির বেশি নতুন বিধিমালা জারি করা হয়েছে।
রাজধানী বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা এখনই শহরের কেন্দ্রস্থলে রোবোট্যাক্সি চলাচলের অনুমতি দিতে নারাজ। সাংহাই কর্তৃপক্ষও পরীক্ষামূলক চলাচলের অনুমতি দিতে দ্বিধায় আছে। এখন পর্যন্ত কোনো কোম্পানিই চীনের কোনো একটি পুরো শহরে রোবোট্যাক্সি চালানোর অনুমতি পায়নি।
চীনের ভেতরে লাভের মুখ দেখা না যাওয়ায় এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি হওয়ায় চীনা রোবোট্যাক্সি পরিচালনাকারীরা এখন বিদেশের দিকে নজর দিচ্ছে। এর পেছনে আরেকটি কারণ হলো বৈশ্বিক বাজারের বিপুল সম্ভাবনা।
ইউবিএস ব্যাংকের অনুমান, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে ২০৩০-এর দশকের শেষ নাগাদ চীনের বাইরে রোবোট্যাক্সি বাজারটির মূল্য ২১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারটি তাদের জন্য যেন শক্তভাবে বন্ধই রয়েছে।
এই সুযোগ কাজে লাগাতে পনি ডট এআই লুক্সেমবার্গে তাদের পরিষেবা পরীক্ষা করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে তাদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে এবং পুরো দেশে রোবোট্যাক্সি চালানোর অনুমতিও পেয়েছে তারা। দুবাইয়েও তাদের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি চলছে।
অন্যদিকে, অ্যাপোলো গো গত বছর চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে প্রথম পরীক্ষা শুরু করে হংকংয়ে। আবুধাবি ও দুবাইয়েও তাদের গাড়ি পরীক্ষার অনুমতি আছে। সুইজারল্যান্ডের বৃহত্তম গণপরিবহন সংস্থা 'পোস্টবাস'-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সেখানেও পরীক্ষা শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
পরের বছর তারা মার্কিন রাইড-হেইলিং কোম্পানি 'লিফট'-এর সঙ্গে জুটি বেঁধে ব্রিটেন ও জার্মানিতেও প্রবেশ করতে পারে। উইরাইড কোম্পানিও চীনের বাইরে ছয়টি দেশে পরীক্ষামূলক বা বাণিজ্যিকভাবে রোবোট্যাক্সি চালানোর অনুমতি পেয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় শীঘ্রই হয়তো চালকবিহীন ট্যাক্সি ডাকা একটি সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠবে।
