অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি, বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার বা আল্ট্রা-প্রসেসড ফুড মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে এই খাবারের লাগাম টানতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল 'দ্য ল্যানসেট'-এ প্রকাশিত একটি বৈশ্বিক গবেষণা পর্যালোচনায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। মানুষ এখন টাটকা ও পুষ্টিকর খাবার ছেড়ে সস্তা ও অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের দিকে ঝুঁকছে। এর ফলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও বিষণ্নতাসহ দীর্ঘস্থায়ী নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
গবেষকরা বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলোকে এখনই 'এগিয়ে আসতে হবে'। তারা অতি-প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলোতে কড়া সতর্কবার্তা উল্লেখ এবং উচ্চ হারে কর আরোপের সুপারিশ করেছেন, যাতে সেই অর্থ ভর্তুকি হিসেবে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার সহজলভ্য করা যায়।
তবে কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার সরাসরি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এই গবেষণা তা প্রমাণ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে আরও গবেষণা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন।
অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, এতে এমন পাঁচটির বেশি উপাদান থাকে, যা সাধারণত বাড়ির রান্নাঘরে পাওয়া যায় না। যেমন- ইমালসিফায়ার, প্রিজারভেটিভ, রং ও কৃত্রিম মিষ্টি। এর পরিচিত উদাহরণগুলো হলো- সসেজ, চিপস, পেস্ট্রি, বিস্কুট, ইনস্ট্যান্ট স্যুপ, কোমল পানীয়, আইসক্রিম এবং বাজারে বিক্রি করা পাউরুটি।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে মানুষের খাদ্য তালিকায় শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত এসব খাবারের পরিমাণ বাড়ছে। এর ফলে আমাদের খাবারের গুণমান খারাপ হচ্ছে, কারণ এতে প্রচুর চিনি ও অস্বাস্থ্যকর চর্বি থাকলেও; ফাইবার (আঁশ) ও প্রোটিন প্রায় থাকে না বললেই চলে।
৪৩ জন বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে এবং ১০৪টি দীর্ঘমেয়াদী গবেষণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার অন্তত ১২টি স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। এর মধ্যে রয়েছে- টাইপ-২ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, বিষণ্নতা এবং যেকোনো কারণে অকাল মৃত্যু।
ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গবেষণা পর্যালোচনার লেখক কার্লোস মন্টিরো বলেন, 'অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার 'বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভ্যাসকে বদলে দিচ্ছে এবং টাটকা ও কম প্রক্রিয়াজাত খাবারকে বাজার থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'মানুষের খাদ্যাভ্যাসের এই পরিবর্তন করছে শক্তিশালী বৈশ্বিক কর্পোরেশনগুলো। তারা অতি-প্রক্রিয়াজাত পণ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশাল মুনাফা করছে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস সহায়ক কার্যকর জনস্বাস্থ্য নীতিগুলো বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে তারা বিশাল বিপণন এবং রাজনৈতিক লবিংয়ের সহায়তা নিচ্ছে।'
গবেষণার সহ-লেখক সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফিলিপ বেকার বলেন, এর সমাধান হলো 'তামাক শিল্পের বিরুদ্ধে যেভাবে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য পদক্ষেপ নিতে হবে'।
তবে গবেষকরা স্বীকার করেছেন, যে, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার ঠিক কীভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে তা দেখানোর মতো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অভাব রয়েছে।
কিছু বিজ্ঞানীর মতে, মানুষের জীবনযাত্রার অন্যান্য বিষয় যেমন: লাইফস্টাইল, আচরণ এবং সম্পদের প্রভাব থেকে অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রভাব আলাদা করা কঠিন।
সমালোচকরা আরও বলছেন, 'নোভা ক্লাসিফিকেশন' পদ্ধতিতে খাবারের পুষ্টিগুণ বিচার না করে কেবল প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়। যেমন:হোলগ্রেইন ব্রেড, ফিশ ফিঙ্গার বা শিশুদের ফর্মুলা দুধ প্রক্রিয়াজাত হলেও পুষ্টিকর।
ওপেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কেভিন ম্যাককনওয়ে বলেন, 'এ ধরনের গবেষণা রোগের সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক (কো-রিলেশন) দেখাতে পারে, কিন্তু কার্যকারণ (কজ অ্যান্ড এফেক্ট) নিশ্চিত করতে পারে না।'
তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনও 'সন্দেহের অবকাশ এবং পরবর্তী গবেষণার মাধ্যমে স্পষ্টীকরণের সুযোগ রয়েছে'।
তিনি আরও বলেন, 'আমার মনে হয় অন্তত কয়েকটি অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। কিন্তু এটি নিশ্চিত করে না যে সব অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।'
অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবারের ঠিক কোন বিষয়টি রোগ সৃষ্টি করে বা রোগ সৃষ্টি ভূমিকা রাখছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জুলস গ্রিফিন বলেন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। এটি কীভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে তা বোঝার জন্য আরও গবেষণা 'জরুরি'।
খাদ্য ও পানীয় শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা 'ফুড অ্যান্ড ড্রিঙ্ক ফেডারেশন' (এফডিএফ) বলেছে, কোনো কোনো অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার সুষম খাদ্যের অংশ হতে পারে। যেমন: হিমায়িত মটরশুঁটি এবং হোলমিল ব্রেড।
এফডিএফ-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কেট হলিওয়েল বলেন, 'কোম্পানিগুলো সরকারি নির্দেশিকা মেনে আমাদের বিক্রি করা খাবার ও পানীয় স্বাস্থ্যকর করার জন্য বহু বছর ধরে ধারাবাহিক পরিবর্তন আনছে।'
তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সাল থেকে দোকান ও সুপারমার্কেটে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলোতে চিনি ও লবণের পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ কমেছে।
যুক্তরাজ্যের 'সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি কমিটি অন নিউট্রিশন' এই বছরের শুরুতে বলেছিল, অতি-প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পরার বিষয়টি 'উদ্বেগজনক'।
তবে তারা আরও বলেছিল, প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণে এই খাবারগুলো অস্বাস্থ্যকর কি না, নাকি এগুলোতে উচ্চ ক্যালরি, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, লবণ এবং খোলা চিনি থাকার কারণে অস্বাস্থ্যকর; তা 'অস্পষ্ট'।
বর্তমানে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের পরামর্শ হলো- বেশি করে ফল, শাকসবজি এবং ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া এবং চিনি, চর্বি ও লবণ খাওয়া কমানো।
