এপস্টিনের নথি প্রকাশে কংগ্রেসের অনুমোদন, পাঠানো হচ্ছে ট্রাম্পের কাছে
কংগ্রেসের উভয় কক্ষই যৌন অপরাধী অর্থদাতা জেফরি এপস্টেইনের ফাইলগুলো প্রকাশের জন্য মার্কিন বিচার বিভাগকে নির্দেশ দিতে সম্মত হয়েছে। খবর বিবিসির।
হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ৪২৭-১ ভোটে এই প্রস্তাবের অনুমোদন দিয়েছে এবং সিনেট কোনো আনুষ্ঠানিক ভোট ছাড়াই সর্বসম্মতিক্রমে এটির দ্রুত অনুমোদন দিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অবস্থান পরিবর্তন এবং তার বহু সমর্থকের পক্ষ থেকে জনগণের চাপের পর রেকর্ডগুলো প্রকাশ করার জন্য কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানালে এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়।
গত সপ্তাহে, ২০ হাজারেরও বেশি পৃষ্ঠার নথি প্রকাশ হওয়ার পরে ট্রাম্প এবং এপস্টিনের সাথে তার সম্পর্ক আবার সংবাদের শিরোনামে আসে। তবে হোয়াইট হাউস কোনো ভুল বা অন্যায় কাজের কথা অস্বীকার করেছে।
লুইজিয়ানার রিপাবলিকান ক্লে হিগিন্স একাই হাউসে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন, এবং তিনি তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে "নির্দোষ লোকেদের ক্ষতি হওয়ার" আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
ফাইলগুলো প্রকাশ করার পক্ষে যারা ক্যাপিটল হিলে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কথা না বলে ট্রাম্প যখন বললেন যে "লুকানোর কিছু নেই", তখন তার কথায় ওয়াশিংটনের কেউ কেউ অবাক হয়েছিলেন।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্পের বার্তার সাথে নিজেদের বক্তব্য মিলিয়ে এবং ফাইলগুলো প্রকাশের বিরোধিতা করার পর রিপাবলিকান কংগ্রেসনাল নেতৃত্ব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন।
হাউস স্পিকার মাইক জনসন বারবার এপস্টিনের ফাইল প্রকাশের দাবিকে "ডেমোক্র্যাটদের প্রতারণা" বলে অভিহিত করেন।
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে প্রস্তাবটি যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটে পৌঁছাতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তবে বিকেলে হাউসে বিপুল সমর্থনে এটি পাস হওয়ার পর সময়সূচি দ্রুত এগিয়ে যায়।
সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার 'ইউনানিমাস কনসেন্ট' নামে পরিচিত একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিলটি উত্থাপন করেন। যেহেতু কেউ আপত্তি জানায়নি, তাই কোনো বিতর্ক হয়নি এবং বিলটিতে কোনো সংশোধনীও যোগ করা হয়নি।
এটি সিনেট থেকে প্রেসিডেন্টের ডেস্কে যাবে। সেখানে ট্রাম্প এ আইনে স্বাক্ষর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এপস্টিনের নথি প্রকাশে কংগ্রেসের ভোট আসলে প্রয়োজন ছিল না—ট্রাম্প নিজেই চাইলে এগুলো প্রকাশের নির্দেশ দিতে পারতেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
নতুন বিল অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডিকে আইন কার্যকর হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এপস্টিন এবং তার সহযোগী গিসলেইন ম্যাক্সওয়েল সম্পর্কিত 'গচ্ছিত বা অগচ্ছিত সব রেকর্ড, নথি, যোগাযোগ এবং তদন্তের উপকরণ' প্রকাশ করতে হবে।
এই উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, ফ্লাইট লগ এবং এপস্টিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর তথ্যও।
তবে বিলটি বন্ডিকে এমন তথ্য গোপন রাখার ক্ষমতাও দিয়েছে, যা প্রকাশ করলে কোনো সক্রিয় ফেডারেল তদন্ত ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বা কোনো ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে।
অর্থদাতা জেফ্রি এপস্টিনকে ২০১৯ সালে নিউইয়র্কের কারাগারে তার কক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং ময়নাতদন্তকারী তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে রায় দেন।
তিনি সেই সময় যৌন পাচারের অভিযোগে আটক ছিলেন। এর আগে ২০০৮ সালে তিনি এক অপ্রাপ্তবয়স্কের কাছ থেকে যৌনসেবা গ্রহণের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।
এপস্টিনকে কেন্দ্র করে দুটি ফৌজদারি তদন্তের সময় হাজার হাজার নথি সংগ্রহ করা হয়। এসবের মধ্যে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সাক্ষাৎকারের ট্রান্সক্রিপ্টও ছিল।
ট্রাম্প এবং এপস্টিন একসময় একই সামাজিক পরিমণ্ডলে মেলামেশা করতেন, তবে প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে তিনি ২০০৮ সালের দণ্ডের অনেক আগেই এপস্টিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তিনি আরও বলেন যে এপস্টিনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না।
গত সপ্তাহে, হাউস ওভারসাইট কমিটির ডেমোক্র্যাটরা তিনটি ইমেইল চেইন প্রকাশ করেন, যার মধ্যে এপস্টিন এবং গিসলেইন ম্যাক্সওয়েলের ইমেইলও ছিল। ম্যাক্সওয়েল বর্তমানে যৌন পাচারের দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
প্রকাশিত ইমেইলগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে ট্রাম্পের কথাও উল্লেখ আছে। ২০১১ সালে এপস্টিন ম্যাক্সওয়েলকে পাঠানো একটি ইমেইলে তিনি লিখেছিলেন: "আমি চাই তুমি বুঝতে পারো যে কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করেনি, সে ট্রাম্প.. [ভুক্তভোগী] আমার বাড়িতে তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি।"
গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে যে এই ইমেইলে উল্লেখিত ভুক্তভোগী ছিলেন এপস্টিনের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিযুক্ত ভার্জিনিয়া জিউফ্রে।
এপ্রিল মাসে মারা যাওয়া জিউফ্রে বলেন, তিনি কখনও ট্রাম্পকে কোনো নির্যাতনে অংশগ্রহণ করতে দেখেননি এবং ইমেইলগুলোতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিতও নেই।
ট্রাম্প এপস্টিন সম্পর্কিত কোনো অপরাধের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছেন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট বলেন যে এই ইমেইলগুলো 'সিলেকটিভভাবে' প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাটরা গণমাধ্যমে ফাঁস করেছে। এর মাধ্যমে তারা চেয়েছিল যাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কলঙ্কিত করার জন্য একটি ভুয়া গল্প তৈরি করা যায়।
বিচার বিভাগের কাছে থাকা তদন্তের ফাইলগুলো প্রকাশের জন্য চাপ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রিপাবলিকান থমাস ম্যাসি। ম্যাসি কেন্টাকির কংগ্রেসম্যান। তিনি কখনও কখনও তার দলের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন। ম্যাসির সঙ্গে আরেকজন ছিলেন ডেমোক্র্যাট রো খান্না (ক্যালিফোর্নিয়ার কংগ্রেসম্যান)। এই দুজনই এই আইনটি উপস্থাপন করেছিলেন।
ফাইলগুলো প্রকাশের জন্য চাপ দেওয়ায় ম্যাসিকে ট্রাম্পের কাছে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তবে তিনি তার অবস্থানে অটল ছিলেন।
থমাস ম্যাসি গত সপ্তাহের শেষে এবিসি নিউজকে বলেন, "২০৩০ সালে তিনি (ট্রাম্প) প্রেসিডেন্ট হবেন না।" তিনি আরও বলেন, "যে রিপাবলিকানরা নথি প্রকাশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন, তারা শিশু শিকারিদের রক্ষা করার জন্য ভোট দিয়েছেন।"
আরেক রিপাবলিকান যিনি নথি প্রকাশের পক্ষে এগিয়েছেন, তিনি হলেন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য মারজরি টেলর গ্রিন। তিনি পূর্বে ট্রাম্পের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তবে এ বিষয়ে তাদের মতের ভিন্নতার কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়, এবং বর্তমানে ট্রাম্প তাকে 'প্রতারক' বলে মন্তব্য করেছেন।
মঙ্গলবার দিনের বেলায় একটি সংবাদ সম্মেলনে গ্রিন বলেন যে তিনি এপস্টিনের জীবিত ভুক্তভোগীদের পক্ষে কথা বলছেন। তিনি ট্রাম্পকে সরাসরি উদ্দেশ্য করেও মন্তব্য করেন।
গ্রিন বলেন, "বিশ্বাসঘাতক কাকে বলে, তা আমাকে বলতে দিন। একজন বিশ্বাসঘাতক হলো সেই আমেরিকান, যে বিদেশী রাষ্ট্র এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে; একজন দেশপ্রেমিক হলো সেই আমেরিকান, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের মতো আমেরিকানদের সেবা করে।"
গ্রিন বলেন যে এপস্টিনকে ঘিরে এই বিরোধ ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই। এটি তার 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' ক্যাম্পেইনের জন্য সবচেয়ে "ধ্বংসাত্মক বিষয়গুলোর" মধ্যে একটি।
এপস্টিনের নির্যাতনের জীবিত ভুক্তভোগীরাও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন, আইন প্রণেতাদের ফাইলগুলো প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করেন এবং ট্রাম্পকেও তা করার জন্য চাপ দেন।
এপস্টিনের ভুক্তভোগী অ্যানি ফার্মার বলেন, যে ফাইলগুলো লুকিয়ে রাখা "প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসঘাতকতার" সমান।
তিনি আরও বলেন, "যেহেতু এই অপরাধগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়নি, তাই আরও অনেক কিশোরী এবং নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।"
