‘গণতন্ত্র’ সেমিনার বাতিল, একই দিনে ‘গো-কল্যাণ’ সম্মেলনের নির্দেশনা: ভারতের শিক্ষাঙ্গনে বাড়ছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শঙ্কা
ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'গণতন্ত্র' বিষয়ক একটি সেমিনার বাতিল এবং একই দিনে অধ্যক্ষদের 'গো-কল্যাণ' বিষয়ক একটি সম্মেলনের প্রচারে অংশ নিতে নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
দেশের মুক্ত চিন্তার কেন্দ্র হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে পরিচিত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই নির্দেশনা মোদি সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টির একটি উদাহরণ। ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রে হিন্দুত্ববাদকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ।
ভারতে হিন্দুদের কাছে গরুকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হলেও সমালোচকদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) তাদের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে গরুর প্রতি এই ধর্মীয় ভক্তিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
জানা যায়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ছয় দশক ধরে অনুষ্ঠিত একটি বক্তৃতা সিরিজের অংশ হিসেবে 'ভূমি, সম্পত্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার' শিরোনামে সেমিনারটি হওয়ার কথা ছিল।
সিএনএন-এর হাতে আসা একটি ই-মেলের কপি অনুযায়ী, গত ৩১ অক্টোবরের সেমিনারটি বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন বলরাম পানি অধ্যক্ষদের একটি নির্দেশনা পাঠান। এতে শিক্ষার্থী ও অনুষদের সদস্যদের 'ন্যাশনাল গোধান সামিট'-এ যোগ দিতে উৎসাহিত করা হয়।
আয়োজকদের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গো-কল্যাণ সম্মেলনটিকে 'গরুর কল্যাণ এবং গো-ভিত্তিক টেকসই উদ্ভাবনের প্রচারে নিবেদিত একটি যুগান্তকারী ঘটনা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। 'ন্যাশনাল গোধান অর্গানাইজেশন' সরকারের সঙ্গে যুক্ত একটি এনজিও, যার আয়োজনে সম্মেলনটি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে।
তবে, ডিন বলরাম পানি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় গো-কল্যাণ সম্মেলনটিকে 'প্রচার' না, বরং 'সমর্থন' করছে।
'যদি কেউ জাতির স্বার্থে কাজ করে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশের উন্নতিতে সহায়তা করে, তাহলে আমরা কেন তাকে সমর্থন করব না? তবে আমরা এই ইভেন্টটি প্রচার করছি না। আর যদি কোনো ইভেন্ট জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই তা সমর্থন করব না,' বলেন তিনি।
'রাজনৈতিক দমন-পীড়নের স্পষ্ট উদাহরণ'
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকার এবং স্বার্থের পক্ষে কাজ করা সংগঠন 'ডেমোক্রেটিক টিচার্স ফ্রন্ট' এক বিবৃতিতে বলেছে, 'এই সন্দেহজনক অনুষ্ঠানের প্রচার এবং একই সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার বাতিল – এটি স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করে।'
সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বাতিল হওয়া সেমিনারটির আহ্বায়ক নন্দিনী সুন্দর সেমিনার বাতিলের জেরে আহ্বায়কের পদ থেকে পদত্যাগ করে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে একটি সুচিন্তিত আদর্শিক দমন-পীড়নের অভিযোগ এনেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, '(তারা) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে, শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদী চিন্তাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে।'
সেমিনার বাতিলের প্রাথমিকভাবে কোনো কারণ জানানো হয়নি উল্লেখ করে নন্দিনী সুন্দর এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমরা কেবল অনুমান করতে পারি যে আরএসএস পরিচালিত সরকার ভূমি ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে যেকোনো আলোচনাকে ভয় পাচ্ছে।'
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি দলের আদর্শিক ভিত্তি হলো আরএসএস। যদিও আরএসএস বারবার বলেছে যে তারা সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো বৈষম্য করে না।
বাতিল হওয়া সেমিনারটিতে বক্তব্য রাখার কথা ছিল সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সিনিয়র ফেলো নমিতা ওয়াহির। তিনি মোদি সরকারের ভূমি আইন ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার লঙ্ঘন করে সম্পত্তি অধিগ্রহণের দীর্ঘদিনের সমালোচক।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেমিনারটি বাতিল করার কারণ হিসেবে 'অগ্রিম অনুমতি না নেওয়া'র কথা উল্লেখ করলেও, অধ্যাপক সুন্দর এর বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, 'গত ৬০ বছর ধরে অগ্রিম অনুমতির প্রয়োজন হয়নি। কেউ এই নিয়মিত সেমিনার সিরিজের জন্য আগে থেকে অনুমতি নেয় না।'
অন্যদিকে, আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর সদস্য এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আরিয়ান মান দাবি করেন, আরএসএস-এর মতো সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উপর কোনো প্রভাব নেই এবং এর বিভাগগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে। এই বিষয়ে সিএনএন আরএসএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পায়নি।
ভারতে শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা কী সংকুচিত হচ্ছে?
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘকাল ধরে মুক্তবাক এবং ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার দুর্গ হিসেবে প্রশংসিত। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামে এবং ১৯৭০-এর দশকে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কেন্দ্র হিসেবে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সম্প্রতি ২০১৯ সালে, বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই ক্যাম্পাস।
অধ্যাপক সুন্দর বলেন, 'সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন একটি স্থান যেখানে মানুষ অবাধে বিতর্ক করতে পারে এবং তাত্ত্বিকভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত।' তবে, মোদি সরকারের সমর্থকদের একাংশ এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে 'জাতীয়তাবিরোধী' কার্যকলাপের আখড়া হিসেবে চিহ্নিত করছে, যার জেরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তীব্র চাপের মুখে পড়ছেন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পিএইচডি গবেষক, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিএনএনকে বলেন, 'আগে অন্তত প্রতিবাদ করা যেত…কিন্তু এখন যেকোনো ছাত্র আন্দোলনের ওপর পুলিশের দমন-পীড়ন বেশ দ্রুত ও তাৎক্ষণিক।'
'সমালোচনামূলক চিন্তা করার এবং যৌক্তিক যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে, কারণ তারা আপনার ডিগ্রি জিম্মি করে রেখেছে। তারা আমাদের শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে,' অভিযোগ করেন তিনি।
'ইন্ডিয়ান একাডেমিক ফ্রিডম নেটওয়ার্ক' জানিয়েছে, গত এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিন্দুত্ববাদ অথবা বিজেপির নীতি প্রচারমূলক ৫০টিরও বেশি অনুষ্ঠান ও বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে। একই সময়ে পাঠ্যক্রমে হস্তক্ষেপের কয়েক ডজন ঘটনাও নথিভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে সরকারের সমালোচনামূলক বই নিষিদ্ধ করা, এবং গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক সেমিনারের অনুমতি না দেওয়া বা তাতে বাধা দেওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে গরু
গরুকে একটি ধর্মীয় প্রতীক থেকে জাতীয় গর্বের প্রকাশ হিসেবে তুলে ধরা বিজেপির এজেন্ডার একটি মূল ভিত্তি। ২০১৪ সালে মোদি নির্বাচিত হওয়ার পর, তার দলের ইশতেহারে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ হিসেবে পশুর সুরক্ষার অঙ্গীকার করা হয়। গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার জন্য আরএসএস-এর কয়েক দশক পুরোনো প্রচারণার এটি একটি বাস্তবায়ন ছিল।
বিজেপির শাসনকালে বেশ কয়েকটি রাজ্যে কঠোর গো-হত্যা বিরোধী আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইনি কঠোরতার সাথে যোগ হয়েছে নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধির ঘটনা।
আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের ২০২১ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আরএসএস-এর মতো ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো 'সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর আক্রমণ করার ক্ষেত্রে আরও সাহসী হয়ে উঠেছে।'
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুন্দর শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়াকে 'দুঃখজনক' আখ্যা দিয়ে সতর্ক করে বলেন, 'অনেক চমৎকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে; এখন বাকিগুলোও শেষ হওয়ার পথে।'
