চীনা চিপ নির্মাতা নেক্সপেরিয়াকে নিয়ে টানাপোড়েনে আন্দোলিত বৈশ্বিক গাড়ি শিল্প
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে, নেদারল্যান্ডস সরকার স্নায়ুযুদ্ধ যুগের এক জরুরি আইন প্রয়োগ করে দেশটিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা চীনা মালিকানাধীন- নেক্সপেরিয়া নামের একটি চিপ কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই ঘটনা শুধু বিশ্বজুড়ে গাড়ি শিল্পে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। খবর বিবিসির।
ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও চীনের বিরল খনিজ রপ্তানিতে বিধিনিষেধে বিপর্যস্ত এই খাত— তাতে নতুন করে বড় ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রী সংসদে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, "নেক্সপেরিয়ার অভ্যন্তরে গুরুতর প্রশাসনিক ত্রুটি ও পদক্ষেপগুলো হুমকি সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপটি একেবারেই ব্যতিক্রমী, এবং এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো—ডাচ ও ইউরোপীয় অর্থনীতির জন্য জরুরি প্রযুক্তি ও সরবরাহ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা।"
বেইজিং এই সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে, নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলে। প্রতিক্রিয়ায় তারা ইউরোপে নেক্সপেরিয়া চিপ রপ্তানি স্থগিত করে, এবং ডাচ সরকারও চীনে চিপ তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
ফলে গাড়ি শিল্পে দেখা দেয় বড়সড় অস্থিরতা, যা বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন ফ্রন্ট খুলেছে এই ঘটনা।
চীন পরে বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত চিপের জন্য রপ্তানি ছাড় ঘোষণা করেছে, তবে সেই 'বেসামরিক' সংজ্ঞা কী—তা এখনো স্পষ্ট করেনি।
চীনের কর্তৃপক্ষ চাইছে, নেক্সপেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত বাতিল করুক ডাচ সরকার।
এক বিবৃতিতে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, "চীন আশা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার প্রভাব ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডসকে দ্রুত তার ভুল সিদ্ধান্ত সংশোধনে উদ্বুদ্ধ করবে।"
এবিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিস নেক্সপেরিয়ার মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান- উইংটেক টেকনোলজির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও—তারা এতে সাড়া দেয়নি।
সরবরাহ ব্যবস্থাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার
বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে আন্তর্জাতিক চিপ সরবরাহ শৃঙ্খলের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নেক্সপেরিয়া তৈরি করে তথাকথিত 'লিগ্যাসি' বা 'বিল্ডিং ব্লক' সেমিকন্ডাক্টর, যা পাওয়ার-স্টিয়ারিং, এয়ারব্যাগ, ও সেন্ট্রাল লকিংসহ গাড়ির অসংখ্য মূল অংশে ব্যবহৃত হয়। এগুলো সর্বাধুনিক চিপ নয়, কিন্তু আধুনিক মোটরকার নির্মাণে অপরিহার্য উপকরণ।
একটি গাড়িতে শতাধিক এমন চিপ থাকতে পারে, এবং নেক্সপেরিয়া সেগুলো বিশ্বের বড় বড় কারনির্মাতাদের সরবরাহ করে।
কোম্পানির উৎপাদনের ৭০–৮০% চীনে পাঠানো হয় প্রসেসিং ও প্যাকেজিংয়ের জন্য—যা কার উৎপাদকদের চীনের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
চীন বিশ্লেষক বিল বিশপ তার সিনোসিজম নিউজলেটারে লিখেছেন, "নেক্সপেরিয়া সংকট দেখে গাড়ি নির্মাতাদের উচিত নতুন সরবরাহ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা। কোভিড ও চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার অভিজ্ঞতা থেকে তারা কিছুই শেখেনি।"
এই ঘটনা দেখিয়েছে, চীন চাইলে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে, যেমনটি তারা বিরল খনিজ রপ্তানির ক্ষেত্রে করেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের বিল একিকসনের ভাষায়, "নেক্সপেরিয়ার মতো নিঃশব্দে গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে চীন পশ্চিমাদের কার্যত জিম্মি করতে পারে। এটি যেমন সেমিকন্ডাক্টরের প্রশ্ন, তেমনি ডিজিটাল সার্বভৌমত্বেরও।"
তবে বেইজিং এখন এক দোটানায় পড়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির ফলে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে নিজেকে "বিশ্বস্ত বাণিজ্যিক অংশীদার" হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে চেয়েছে চীন, কিন্তু এখন চিপের মতো জরুরি পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে ভাবমূর্তিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।
"ধারণাটা ছিল—ট্রাম্প যখন এসে সবার জন্য অরাজকতা তৈরি করলেন, তখন হয়তো চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে," বলেন ট্রিভিয়াম চায়নার সহযোগী পরিচালক টম নানলিস্ট।
"কিন্তু তা খুব একটা ভালোভাবে এগোয়নি," তিনি যোগ করেন। বিরল খনিজের সংকট দেখিয়ে দিয়েছে—ইউরোপ ও অন্যান্য বাণিজ্য অংশীদাররা এখন কার্যত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ফেঁসে গেছে, এবং এ দুটি দেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাহত করার সক্ষমতা কতটা গভীর তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তা উদ্বেগ ও আদালতের হস্তক্ষেপ
নেক্সপেরিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ঝ্যাং শুয়েচেনকে নেদারল্যান্ডসের আদালত অপসারণের নির্দেশ দেয় কোম্পানির 'দুর্ব্যবস্থাপনা'র অভিযোগে। শুয়েচেন নেক্সপেরিয়ার চীনা প্যারেন্ট কোম্পানি উইংটেকের প্রতিষ্ঠাতা।
সাংহাই পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত উইংটেক আংশিকভাবে চীন সরকারের মালিকানাধীন এবং ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াচলিস্টে যুক্ত হয়। সেপ্টেম্বরে তালিকাটি সম্প্রসারণ করে এমন সব প্রতিষ্ঠানকেও এর আওতায় আনা হয়, যাদের ৫০% বা তার বেশি শেয়ার ওই তালিকাভুক্ত কোম্পানির মালিকানায় রয়েছে।
ডাচ সরকারের প্রকাশিত নথিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র নেক্সপেরিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে আগে থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল এবং জানায়—চীনা মালিকানা পরিবর্তন করা হলে কোম্পানি হয়তো নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় পেতে পারে।
যদিও দ্য হেগ জানায়, এ সিদ্ধান্ত কোনো বিদেশি চাপের কারণে নেওয়া হয়নি। বরং কারণ হিসেবে একটি তদন্তের কথা উল্লেখ করেছে, যাতে দেখা যায় কোম্পানির সিইও কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা, অর্থ ও মেধাস্বত্ব চীনে স্থানান্তর করছিলেন।
এই বিষয়েও বিবিসির মন্তব্যের অনুরোধে উইংটেক কোনো সাড়া দেয়নি।
ট্রিভিয়াম চায়নার টম নানলিস্ট বলেন, "নেক্সপেরিয়ার ঘটনা আসলে যা আগে থেকেই সত্য ছিল, সেটিকেই আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।"
তার ভাষায়, "পশ্চিমা দেশগুলো এখন আর এমন কৌশলগত উৎপাদন খাতে—যেমন সেমিকন্ডাক্টর বা এমনকি পুরনো প্রযুক্তির চিপ উৎপাদনেও—চীনা বিনিয়োগকারীদের দেখতে চায় না।"
গাড়ি নির্মাতাদের অস্থিরতা ও 'ডিকাপলিং'-এর বাস্তব চিত্র
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ঘটনা প্রমাণ করে—পশ্চিম ও চীনের অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতা বা ডিকাপলিং বাস্তবে কতটা জটিল।
"এটাই করপোরেট পর্যায়ে ডিকাপলিংয়ের বাস্তব রূপ—এবং এটি এক বিশৃঙ্খলা," বলেন ট্রিভিয়াম চায়নার টম নানলিস্ট।
ইউরোপের গাড়ি শিল্প এখন নতুন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিশ্চয়তার মুখে। বিকল্প সরবরাহকারী যেমন ইনফিনিয়ন, এনএক্সপি, টেক্সাস ইন্সট্রুমেন্টস থাকলেও, গাড়ি নির্মাতারা সহজে সরবরাহ শৃঙ্খল বদলাতে পারবে না। কারণ বহু বছরের পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ফলে এটি গড়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি খুবই ভঙ্গুর
এই বিতর্ক এমন এক সময় ঘটছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এক বছরের জন্য বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছেন—যাতে কিছু রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়।
তবে নেক্সপেরিয়া সংকট ইঙ্গিত দেয়—এই যুদ্ধবিরতি অত্যন্ত ভঙ্গুর।
নানলিস্টের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এই কারণে চুক্তি বাতিল করবে না, কিন্তু ইউরোপের অবস্থান সবচেয়ে দুর্বল। "ইউরোপ চাইছে না যে এই সংঘাতের ফলে তাদের চিপ উৎপাদন সক্ষমতা আরও কমে যাক," তিনি বলেন।
ব্রাসেলসও নেদারল্যান্ডসের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিল, কারণ তারা আগেভাগে এ পরিকল্পনার খবর জানত না।
বর্তমানে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চিপ ও বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া নিয়ে জরুরি আলোচনা চলছে।
ইইউ বাণিজ্য কমিশনার মারোস সেফকোভিচ সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে বলেন, "দীর্ঘস্থায়ী, স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি—যাতে সেমিকন্ডাক্টর প্রবাহ সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।"
তবে নেক্সপেরিয়া নিয়ে টানাপোড়েন যে ইউরোপের সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা উন্মোচন করেছে, তা স্পষ্ট—আর মালিকানা ও পরিচালনা নিয়ে দ্বন্দ্ব মেটানো না পর্যন্ত চীন–ইইউ সম্পর্ক চাপের মুখেই থাকবে।
