ইউরোপের আগেই যেভাবে আরব নাবিকরা ভারত মহাসাগরের মানচিত্র আঁকেন
ইসলামের প্রসার নিঃসন্দেহে ভারত মহাসাগরকে এক সূত্রে সংযুক্ত করেছিল, কিন্তু তারও বহু আগে থেকেই এখানে সমুদ্র-বাণিজ্যের এক জমজমাট দুনিয়া ছিল। প্রাচীন যুগে, রোমান বণিকরা দূর-দূরান্তের দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সাথে এই মহাসাগরেই মিলিত হতেন। এর প্রমাণও ছড়িয়ে আছে ইতিহাসে; যেমন, সুদূর ভারতেও রোমান মুদ্রা বা 'অ্যাম্ফোরা' (প্রাচীন নকশার দুই হাতলওয়ালা মাটির পাত্র) খুঁজে পাওয়া গেছে।
এডেন, হরমুজ এবং কালিকটের মতো কিংবদন্তিতুল্য বন্দরগুলো ধীরে ধীরে বিশ্ববাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। সময়ের সাথে সাথে, আরব নাবিকরা সমুদ্রে পথচলার এমন সব কৌশল আয়ত্ত করেন, যা এই বিশাল জলপথে যোগাযোগকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছিল।
আরবদের সামুদ্রিক সোনালী যুগ
প্রাচীনকালের বেশিরভাগ নাবিকের মতোই, আরবের জাহাজগুলোও প্রথমে অচেনা গভীর সমুদ্রে পাড়ি জমানোর সাহস করত না। তারা সাধারণত উপকূলের কাছাকাছি থেকে ছোট ছোট পথে যাতায়াত করত এবং পরিচিত ভূখণ্ড বা চিহ্ন দেখেই পথ চিনত। তখনকার দিনে উন্নত সরঞ্জাম বা জ্ঞানের অভাবে নাবিকরা বেশি দূরে যাওয়ার ঝুঁকি নিত না। সমুদ্রযাত্রার জ্ঞান তখন কোনো বইতে লেখা থাকত না, বরং মুখে মুখে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ত। এত সীমাবদ্ধতার পরেও, ধীরে ধীরে পুরো মহাসাগরজুড়ে বাণিজ্যের একটি বিশাল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
কিন্তু আরবদের সোনালী যুগে (সপ্তম থেকে পঞ্চদশ শতক) ঘটল এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। আরব নাবিকরা প্রকৃতির এক বিশাল রহস্য ভেদ করে ফেলেন—আর তা হলো মৌসুমী বায়ু। তারা বুঝতে পারলেন, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই বাতাস একদিকে বয়, আবার অন্য সময়ে ঠিক তার উল্টো দিকে। এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তারা জাহাজ ছাড়ার এবং ফেরার নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে ফেলেন, যা ছিল এককথায় অবিশ্বাস্য। এর ফলে, গভীর নীল সমুদ্রে পাড়ি জমানো আর কোনো ভয়ের বিষয় রইল না এবং সমুদ্র-বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠল। তখন তাদের এমন নির্ভরযোগ্য যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হলো যা দিয়ে বিশাল সমুদ্রে নির্ভুলভাবে পথ চলা যায়।
এতদিন ধরে চলে আসা মুখে মুখে শেখা জ্ঞানের পাশাপাশি এবার এলো এক নতুন শক্তিশালী হাতিয়ার: মানচিত্র। আরবের খলিফারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় দারুণভাবে উৎসাহ দিতেন। তাঁরা জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের মতো শাস্ত্র ব্যবহার করে নিখুঁত মানচিত্র তৈরির কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এর ফলে, সমুদ্রের স্রোত, উপকূলের সঠিক অবস্থান এবং জাহাজ চালানোর পথগুলো নির্ভুলভাবে পরিমাপ করে চমৎকার সব মানচিত্র তৈরি হলো।
নিয়মিত বাণিজ্যের ফলে পুরোনো বন্দরগুলো যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এডেন বন্দর আফ্রিকা, ভারত এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা পণ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মিলনস্থলে পরিণত হলো। পারস্য উপসাগরের হরমুজ বন্দর যুক্ত করল পারস্য, আরব এবং ভারতীয় বাজারকে। অন্যদিকে, ভারতের কালিকট বন্দরে আরব, চীনা এবং এশিয়ার অন্যান্য বণিকদের আনাগোনায় মুখর থাকত। এভাবেই, ভারত মহাসাগরে আরবরা ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের এক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
তাদের যন্ত্রপাতি ও কৌশল
শুধুমাত্র মৌসুমী বায়ুর সময় জানা বা মানচিত্র ব্যবহার করাই নয়, আরব নাবিকরা তাদের জ্ঞান এবং কৌশলকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। এই অসাধারণ উন্নতির পেছনে ছিল ইসলামের সোনালী যুগের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিশাল অবদান।
গভীর সমুদ্রে পথ খুঁজে বের করার জন্য আরব নাবিকরা আকাশের তারা দেখে পথ চেনা, তারার মানচিত্র, নিজেদের প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং 'অ্যাস্ট্রোলেব'-এর মতো উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করত। এর সাথে ছিল 'কামাল' নামের এক অবাক করা সহজ কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর যন্ত্র। এটি তৈরি হতো একটি চারকোনা কাঠের টুকরো এবং তাতে গিঁট দেওয়া একটি দড়ি দিয়ে। এর সাহায্যে নাবিকরা অক্ষাংশ নির্ণয় করত। দড়িতে বাঁধা ওই কাঠের ফলকের সাহায্যে তারা ধ্রুবতারা বা পরিচিত কোনো তারার সাথে দিগন্তের কৌণিক উচ্চতা মেপে নিজেদের অবস্থান বুঝতে পারত।
তৎকালীন পণ্ডিতেরা একটি অসাধারণ কাজ করলেন। তারা গ্রিক, পারস্য এবং ভারতীয়দের সমুদ্র-বিষয়ক জ্ঞানকে এক করলেন এবং তার সাথে নিজেদের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা মিশিয়ে দিলেন। যেমন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আল-সুফি তাঁর 'বুক অফ ফিক্সড স্টারস' বইতে ২৫০টিরও বেশি তারার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিলেন।
আগে বন্দর, বাতাসের ধরন বা জাহাজ চালানোর দিকনির্দেশনার মতো জরুরি তথ্যগুলো নাবিকরা শুধু মুখস্থ করে রাখত। কিন্তু এই যুগে এসে সেই সমস্ত জ্ঞান 'রাহমানিস' নামক নির্দেশিকা বইতে লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়। অবশেষে, পঞ্চদশ শতকে এই বিশাল জ্ঞানভান্ডারের চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় বিখ্যাত আরব নাবিক আহমদ ইবনে মাজিদের লেখা বইটিতে—'দ্য বুক অফ ইউজফুল ইনফরমেশন অন দ্য প্রিন্সিপালস অ্যান্ড রুলস অফ দ্য সি'।
বিশেষ এবং কার্যকরী জাহাজের নকশা
একদিকে আরবের পণ্ডিত ও নাবিকরা যখন জ্ঞান ও কৌশলে উন্নতি করছিলেন, অন্যদিকে তাদের কারিগররা হাতে-কলমে তৈরি করছিলেন এমন সব জাহাজ, যা দেখতে ছিল অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং নকশায় অত্যন্ত উন্নত। এই নকশাগুলো এতটাই যুগান্তকারী ছিল যে, বহু বছর পর ইউরোপের 'আবিষ্কারের যুগে' পর্তুগিজদের মতো শক্তিগুলোও এসব জাহাজের আদলে নিজেদের নৌবহর গড়ে তুলেছিল।
আরবরা ভারতীয়, পারস্য এবং আফ্রিকার পুরোনো জাহাজ নির্মাণের কৌশলের সাথে নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তিকে মিলিয়েছিল। তারা পুরোনো প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করেছিল, যেমন:
তিন কোণা পাল (Lateen Sail): এটি ছিল জাহাজ নির্মাণ প্রযুক্তিতে এক বিশাল অগ্রগতি। এই পালের বিশেষত্ব ছিল, এটি জাহাজকে বাতাসের বিপরীতেও এঁকেবেঁকে চলতে সাহায্য করত। মৌসুমী বায়ুর সময় বা জাহাজকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই পাল ছিল অমূল্য।
সেলাই করা তক্তা: এটি একটি বহু পুরোনো কৌশল, যা আরবরা নিখুঁত করেছিল। জাহাজ নির্মাতারা আক্ষরিক অর্থেই দড়ি দিয়ে তক্তা সেলাই করতেন। তারা তক্তার ধার বরাবর ছোট ছোট ছিদ্র করে তার ভেতর দিয়ে নারকেলের ছোবড়ার দড়ি চালাতেন এবং তক্তাগুলোকে শক্ত করে বেঁধে দিতেন। এর ফলে জাহাজগুলো প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতেও ভেঙে না গিয়ে বরং কিছুটা নমনীয় থাকত এবং টিকে যেত। রজন বা আঁশের মতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তক্তার মাঝের ফাঁক বন্ধ করা হতো, যা জাহাজকে জলরোধী করত।
কারিগররা 'ধাও' এবং 'সাম্বুক'-এর মতো পুরোনো ধরনের জাহাজের গঠন উন্নত করে তাতে তিন কোণা পাল জুড়ে দেয়। ষোড়শ শতকে ধাও জাহাজের সবচেয়ে আধুনিক রূপটি তৈরি হয়, যার নাম ছিল 'বাগলা'।
বাগলা জাহাজ ছিল এককথায় রাজকীয়। এটি প্রায় ১০০ ফুট লম্বা হতো, এর সামনের অংশটা ছিল ধনুকের মতো বাঁকানো আর উঁচু, এবং পেছনের অংশ ছিল সমতল। সাধারণত এতে দুই বা তার বেশি তিন কোণা পাল থাকত। বড় আকারের বাগলা জাহাজগুলো ৪০০ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারত। কেবল তাদের এই বিশাল আকৃতির কারণেই আরবরা কয়েক শতাব্দী ধরে ভারত মহাসাগরের বাণিজ্য নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছিল। বেশিরভাগ আরব জাহাজ তৈরি হতো ইয়েমেন, ওমান অথবা ভারতের গুজরাটে।
শুধু মানচিত্র তৈরিই নয়
আরব নাবিকদের অবদান কেবল ভৌত মানচিত্র তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সপ্তম শতকের শেষের দিকে আরবে যখন ইসলামের প্রসার ঘটছিল, ঠিক একই সময়ে সমুদ্রপথেও তাদের প্রভাব বাড়ছিল। তৎকালীন খলিফারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বাণিজ্যকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন। এর ফলে, আরব বণিকরা তাদের পরিচিত অঞ্চলের গণ্ডি ছাড়িয়ে পূর্ব আফ্রিকা, ভারত এমনকি ইন্দোনেশিয়ার আচেহ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
এই বন্দরগুলোর অনেক জায়গায় তারা নিজেদের ছোট ছোট বসতি, মসজিদ এবং স্থানীয়দের সাথে যোগাযোগের কেন্দ্র স্থাপন করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের এই প্রসারের সাথে হাত ধরাধরি করে ছড়িয়ে পড়ছিল ইসলাম ধর্ম, যা ধীরে ধীরে পুরো অঞ্চলটিকে একটি অভিন্ন বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সুতোয় বেঁধে ফেলে।
একটি সাধারণ ভুল ধারণা
ইউরোপীয়রা যখন ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে, তখন তারা কোনো খালি বা অনাবিষ্কৃত জায়গায় এসে পড়েনি। তারা সেখানে আগে থেকেই চালু থাকা এক বিশাল এবং সুসংগঠিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থা দেখতে পায়। তাই তাদের সমুদ্রপথ 'আবিষ্কারের' গল্পটি পুরোপুরি সত্য নয়।
সত্যি কথা হলো, আরব পণ্ডিত এবং নাবিকরা তাদের বহু আগেই পুরো ভারত মহাসাগরকে বাণিজ্য, জ্ঞান এবং সংস্কৃতির এক শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। ইউরোপীয়রা আসলে এমন এক সচল, সুসংগঠিত এবং জীবন্ত ব্যবস্থার মধ্যে এসে প্রবেশ করে যা আরব নাবিক ও পণ্ডিতরা শত শত বছরের পরিশ্রমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন।
অনুবাদ: নাফিসা ইসলাম মেঘা
