মিথ্যা মামলায় জেলে ৪৩ বছর, মুক্তি পেতেই এবার ভারতে নির্বাসনের মুখে মার্কিন নাগরিক
একটি হত্যাকাণ্ডে ভুলভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ৪৩ বছর কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন সুব্রহ্মণ্যম (সুবু) বেদাম। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে দেখা করার আগেই তাকে হেফাজতে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)। তাকে ভারতে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছে তারা—যে দেশে তিনি মাত্র নয় মাস বয়স পর্যন্ত ছিলেন, এরপর আর কখনো পা রাখেননি।
এই মাসের শুরুর দিকে নতুন প্রমাণের ভিত্তিতে তার সাবেক রুমমেট টম কিনসারের হত্যার অভিযোগ থেকে সুবুকে নির্দোষ প্রমাণিত করে রায় দেয়া হয়। তবে ১৯৮৮ সালের একটি পুরোনো নির্বাসন আদেশের [ডিপোর্টেশন অর্ডার] কারণে এখন তাকে আবার আটক করে আইসিই।
সুবুর আইনজীবীরা এখন সেই আদেশের বিরুদ্ধে লড়ছেন। তার পরিবারও তাকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করার চেষ্টায় ব্যস্ত।
সুবুর বোন সরস্বতী বেদম বিবিসিকে বলেন, তার পরিবার এখন 'একেবারে ভিন্ন এক পরিস্থিতি' মোকাবিলার চেষ্টা করছে। তার ভাই এমন একটি কারাগার থেকে এসেছেন, যেখানে তিনি কয়েদি ও রক্ষীদের ভালোভাবে চিনতেন, অন্য কয়েদিদের পরামর্শ দিতেন এবং তার নিজস্ব সেল [কারাকক্ষ] ছিল। কিন্তু এখন তাকে এমন একটি আটককেন্দ্রে রাখা হয়েছে, যেখানে ৬০ জন পুরুষের সঙ্গে একটি ঘর ভাগাভাগি করতে হচ্ছে, যারা কেউই তার অতীত সম্পর্কে জানে না।
এই নতুন পরিস্থিতিতেও বেদম তার বোন এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের একটি কথাই বারবার বলছেন, 'আমি চাই আমরা এই জয়টাকেই গুরুত্ব দিই'। 'আমার নাম এখন পরিষ্কার, আমি আর কয়েদি নই, আমি একজন আটক ব্যক্তি।'
১৯৮০ সালের হত্যাকাণ্ড
৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে, সুবু তার একসময়ের রুমমেট, ১৯ বছর বয়সী কলেজ ছাত্র টম কিনসারকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। কিনসার নিখোঁজ হওয়ার নয় মাস পর একটি জঙ্গল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যার মাথার খুলিতে গুলির ক্ষত ছিল।
কিনসার যেদিন নিখোঁজ হন, সেদিন সুবু তার কাছে গাড়ি চেয়ে নিয়েছিলেন। কিনসারের গাড়িটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেরত আনা হলেও, কে ফেরত এনেছিল তা কেউ দেখেনি।
এই ঘটনার জেরে কিনসারের হত্যার অভিযোগে বেদমকে অভিযুক্ত করা হয়। তার জামিন নামঞ্জুর করা হয়, পাসপোর্ট ও গ্রিন কার্ড জব্দ করা হয় এবং তাকে 'পালিয়ে যেতে পারে এমন বিদেশি' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দুই বছর পর তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৮৪ সালে মাদক সংক্রান্ত একটি অপরাধে আলাদা করে দুই থেকে সাড়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা একসঙ্গে ভোগ করার নির্দেশ ছিল।
তবে শুরু থেকেই হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিলেন সুবু। তার সমর্থক ও পরিবারের সদস্যরা বরাবরই দাবি করেছেন, এই অপরাধের সঙ্গে তাকে যুক্ত করার মতো কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল না।
মুক্তি ও নতুন বিপদ
সুবু তার সাজার বিরুদ্ধে বারবার আপিল করেন। কয়েক বছর আগে এই মামলায় নতুন প্রমাণ সামনে আসে, যা তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সাহায্য করে। এই মাসের শুরুতে, সেন্টার কাউন্টির ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি বার্নি ক্যানটোর্না জানান, তিনি সুবুর বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা চালাবেন না।
কিন্তু সুবুর পরিবার জানত, তার মুক্তির পথে আরও একটি বাধা রয়েছে: ১৯৮৮ সালের একটি নির্বাসন আদেশ, যা তার হত্যা ও মাদক সংক্রান্ত সাজার ভিত্তিতে জারি করা হয়েছিল।
সরস্বতী বেদম বলেন, তারা ধারণা করেছিলেন যে, তার অভিবাসন মামলাটি পুনরায় খোলার জন্য একটি আবেদন করতে হবে, কারণ মামলার প্রেক্ষাপট এখন ভিন্ন। কিন্তু আইসিই সেই সুযোগ না দিয়ে পুরনো অভিবাসন আদেশের কথা উল্লেখ করে তাকে পেনসিলভেনিয়ার অন্য একটি আটককেন্দ্রে দ্রুত নিয়ে যায়।
আইসিই-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হত্যার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেও তার মাদক সংক্রান্ত সাজা এখনও বহাল রয়েছে। সংস্থাটি আরও জানায়, তারা একটি আইনসম্মতভাবে জারি করা আদেশের ভিত্তিতেই কাজ করেছে।
যদিও আইসিই বিবিসির মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি, তবে অন্যান্য মার্কিন গণমাধ্যমকে জানিয়েছে যে, নির্বাসনের প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেদম তাদের হেফাজতেই থাকবেন।
সুবুর পরিবার বলছে, কারাগারে থাকাকালীন তার কয়েক দশকের ভালো আচরণ, তিনটি ডিগ্রি অর্জন এবং সমাজসেবামূলক কাজ—এই বিষয়গুলো অভিবাসন আদালতের বিবেচনা করা উচিত।
সরস্বতী বলেন, 'সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা তাকে এক মুহূর্তের জন্যও বুকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। তাকে অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, তিনি যেভাবে সম্মান, সততা আর লক্ষ্য নিয়ে জীবনযাপন করেছেন, তার কোনো মূল্য থাকা উচিত।'
নির্বাসনের শঙ্কায় এক অচেনা দেশে
সুবুর পরিবার জোর দিয়ে বলেছে, ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত দুর্বল। আইসিই তাকে সেখানেই নির্বাসিত করতে চায়। তিনি ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও মাত্র নয় মাস বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। সরস্বতী বিবিসিকে জানান, সেখানে তার যে আত্মীয়রা বেঁচে আছেন, তারা অনেক দূরের। তার আপন পরিবার—বোন, চার ভাগ্নি এবং অন্য আত্মীয়রা—সবাই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় থাকেন।
সরস্বতী বলেন, 'পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পাঠিয়ে দিলে তার জীবন থেকে কাছের মানুষদের আবারও কেড়ে নেওয়া হবে। এটা অনেকটা তার জীবনকে দুইবার কেড়ে নেওয়ার মতো।'
বেদম একজন আইনত স্থায়ী বাসিন্দা এবং গ্রেফতারের আগেই তার নাগরিকত্বের আবেদন গৃহীত হয়েছিল। তার বাবা-মা দুজনেই মার্কিন নাগরিক ছিলেন।
তার আইনজীবী আভা বেনাচ এক বিবৃতিতে বিবিসিকে বলেন, 'আমরা বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে এমন একটি দেশে নির্বাসিত করা, যেখানে তার তেমন কোনো যোগাযোগ নেই, তা হবে আরও একটি ভয়ঙ্কর ভুল। এই মানুষটি ইতোমধ্যেই এক নজিরবিহীন অবিচারের শিকার হয়েছেন।'
