দুই বছর পর ‘ঘরে ফেরা’—ঘর কোথায়, কেবলই ধ্বংসস্তূপ আর হাহাকার, তবু খুশির ঝিলিক
শুক্রবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজার দক্ষিণ থেকে গাজা সিটির পানে দীর্ঘ, ধুলোমাখা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন হাজারো ফিলিস্তিনি। চোখের সামনে নিজেদের শহরকে তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখেছেন, তবু ঘরে ফিরতে পেরেই পাচ্ছেন স্বস্তি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েল উপত্যকাটিতে পাল্টা নির্বিচার হামলা শুরু করলে উত্তর গাজার কার্যত পুরো জনগোষ্ঠীই বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। গত দুই বছরে এই এলাকা পরিণত হয়েছে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে।
আকাশ থেকে তোলা ফুটেজে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কেবলই ধ্বংসস্তূপ, আর কিছু নেই। নেই কোনো অবকাঠামো, বিদ্যুৎ বা পানি সরবরাহ।
তবু শুক্রবার যারা এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন, তাদের বেশিরভাগের কাছেই ফিরে আসা নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না।

আহমাদ আবু ওয়াতফা সিএনএনকে বলেন, 'দোয়া করি আল্লাহ যেন আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করেন, মানুষ যেন তাদের ঘরে ফিরে আসতে পারে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেলেও আমরা ফিরব, ইনশাআল্লাহ।'
আবু ওয়াতফা সিএনএনের সাথে কথা বলছিলেন গাজা শহরের শেখ রাদওয়ান এলাকায় নিজের বাড়িতে ফেরার পথে। তিনি জানেন, বাড়ি বলতে যা বোঝায়, সেখানে হয়তো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই—তবু তীব্র এক আননন্দের আবেশে ভাসছেন তিনি।
আবু ওয়াতফা বলেন, 'এর চেয়ে সুন্দর অনুভূতি আর কিছু হতে পারে না—দক্ষিণ থেকে উত্তরে ফিরে আসার এই অনুভূতি।'

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র বলেছেন, উপকূলীয় আল-রশিদ সড়ক ও গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সালাহ আল-দিন সড়ক দিয়ে মানুষকে দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
উত্তর গাজার অনেক বাসিন্দার জন্য শুক্রবার ছিল বাড়ি ফেরার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা।
যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরায়েল উত্তর গাজার বেশিরভাগ বাসিন্দাকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করলেও গত জানুয়ারিতে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির সময় তারা কিছু অংশে মানুষকে অল্প সময়ের জন্য ফিরতে দিয়েছিল।

কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের জন্য সেই ঘরে ফেরা ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ সেপ্টেম্বরের শুরুতে শহরটিতে স্থল অভিযান চালানোর আগে ইসরায়েল ফের গাজা শহর পুরোপুরি খালি করার নির্দেশ দেয়।
আইডিএফ তখন সিএনএনকে জানিয়েছিল, ওই নির্দেশের পর ৬ লাখ ৪০ হাজার মানুষ শহর ছেড়েছে। এই সংখ্যাটি ছিল গাজা শহরের যুদ্ধ-পূর্ববর্তী জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ। যদিও এই পরিসংখ্যান যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
ওই স্থল অভিযানের আগেও গাজা শহরের পরিস্থিতি ছিল গুরুতর। সেখানে কোনো হাসপাতাল পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। আশ্রয়ের জন্য তেমন কোনো জায়গাও ছিল না।

শুক্রবার গাজা সিটির আল রানতিসি হাসপাতালের চিকিৎসক দলগুলো হাসপাতালে ফিরে এসে দেখে, জায়গাটা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. ইউসেফ আবু আল রিশ সিএনএনকে ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও পাঠান। এতে ধ্বংসস্তূপ এবং পোড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া চিকিৎসা সরঞ্জাম দেখা যায়।
জাতিসংঘ-সমর্থিত উদ্যোগ ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানিয়েছে, আগস্টে গাজা শহরে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। এরপর থেকে তা উপত্যকার বাকি অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ধ্বংসস্তূপের মাঝে হাহাকার
উত্তরে ফিরতে শুরু করা মানুষদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ সব দৃশ্য। শহর থেকে পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, অজস্র বহুতল ভবন পুরোপুরি মাটির সাথে মিশে গেছে, বাকিগুলো বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছে। গোটা এলাকা যেন ধূসর ধুলোয় ঢাকা পড়েছে, অন্য কোনো রঙের অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।
উত্তরের আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়া সিএনএনকে জানান, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শহরের কিছু এলাকা থেকে সরে যাওয়ার পর শুক্রবার গাজা শহর থেকে অন্তত ৩৩ জন ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

তিনি বলেন, কয়েকটি মরদেহ শনাক্ত করা অসম্ভব ছিল। এ কারণে সেগুলো হাসপাতালে পাঠানো হয়, যাতে ফরেনসিক দল পরীক্ষা করতে পারবে।
এল হাওয়া এলাকায় একসময় বাড়ি ছিল মাজদি ফুয়াদ মোহাম্মদ আল-খোর-এর। সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে সিএনএনের সাথে কথা বলছিলেন তিনি।
মাজদি জানান, যুদ্ধে তার দুই সন্তান—এক ছেলে ও এক মেয়ে—নিহত হয়েছেন। তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তার মালিকানায় থাকা প্রায় সবকিছুই হারিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'এই বাড়িটি তৈরি করতে চল্লিশ বছরের পরিশ্রম লেগেছে। আমার বয়স এখন ৭০ বছর। ১০ বছর বয়স থেকে আমি কাজ করেছি বিয়ে করার জন্য, এই বাড়ি বানানোর জন্য এবং সন্তান মানুষ করার জন্য। এখন আমি কাজ করতে পারি না, শরীরও আর সায় দেয় না। আমি কোথায় যাব? আমার স্বাস্থ্য আর আগের মতো নেই। আমি বুড়ো, অসুস্থ; কাজ করতে পারি না। আমার স্ত্রীও অসুস্থ, চোখে দেখতে পান না।'

কিছু এলাকা 'অত্যন্ত বিপজ্জনক': ইসরায়েলের হুঁশিয়ারি
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী শুক্রবার জানায়, গাজায় এখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে এবং ইসরায়েলি সরকারের অনুমোদিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সেনারা সরে যাচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তির জন্য ৭২ ঘণ্টার প্রক্রিয়া শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে। চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলে থাকা প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি ও আটক ব্যক্তিকেও মুক্তি দেওয়া হবে।
গাজা সিটির ঠিক উত্তরে অবস্থিত বেইত লাহিয়া শহরের বাসিন্দা সাইর হিকমত সুবহ বলেন, তিনি 'ক্লান্ত ও বীতশ্রদ্ধ'; কিন্তু দ্রুত বাড়ি ফেরার আশা করছেন।
উত্তরের দিকে যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আল-রশিদ সড়কের কাছে নিজের তাঁবু খুলে গুছিয়ে নেওয়ার সময় সুবহ সিএনএনের সাথে কথা বলেন।

তিনি বলেন, 'আমরা খুশি যে সড়কের প্রতিবন্ধকতা সরানো হয়েছে। সবার নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমি অবশ্যই খুশি!'
তবে অভিজ্ঞতা তাকে সতর্ক হতে শিখিয়েছে বলে মন্তব্য করেন সুবহ। 'আমি অনেক তাঁবু খুলেছি, আবার অনেক ফেলেও এসেছি। প্রায় ২০ বার বাস্তুচ্যুত হয়েছি আমি।'
সুবহের এই সতর্কতা যথার্থ। আইডিএফের মুখপাত্র শুক্রবার বলেছেন, গাজার বিভিন্ন এলাকায়, যেমন বেইত হানুন, বেইত লাহিয়া ও শুজাইয়াতে ইসরায়েলি সেনারা উপস্থিত থাকবে। মানুষকে সেসব এলাকা এড়িয়ে চলতে সতর্ক করে দিয়েছে।
মুখপাত্র বলেন, 'যেসব এলাকায় সেনারা অবস্থান করছে, তার কাছাকাছি যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।'