মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে জান্তার নতুন প্রাণঘাতী অস্ত্র; কী এই ‘প্যারামোটর’?

মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় সাগাইং অঞ্চলের গত সোমবার রাতের ঘটনা। চ্যাং ইউ টাউনশিপে পূর্ণিমা উপলক্ষে আয়োজিত 'থাডিংইয়ুত' উৎসবে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় ১০০ মানুষ।
তাদের কারও কারও হাতে ছিল মোমবাতি। উৎসবের পাশাপাশি এটি ছিল ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলকারী জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদও, যারা দেশটিকে এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
কিন্তু উৎসবের সেই আনন্দ মুহূর্তেই পরিণত হয় বিভীষিকায়, যখন একটি মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার (স্থানীয়ভাবে প্যারামোটর হিসেবে পরিচিত) উপর থেকে উড়ে এসে ভিড়ের ওপর বোমা ফেলে।
মাত্র সাত মিনিটের সেই হামলায় অন্তত ২৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হন, আহত হন আরও কয়েক ডজন।
হামলার শিকার ৩০ বছর বয়সী একজন বলেন, 'প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার শরীরের নিচের অংশটুকু বোধ হয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।' কোনোমতে কাছের একটি নালায় আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি। তার কথায় ঝরে পড়ে তীব্র ক্ষোভ, 'এটা গণহত্যা! তারা প্রকাশ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে!'
২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ দমনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার চালানো নৃশংস বিমান হামলাগুলোর মধ্যে এটি সর্বশেষ সংযোজন। এটি এও স্পষ্ট করে যে, স্বল্প প্রযুক্তির কিন্তু মারাত্মক এই প্যারামোটর এখন দেশটির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে জান্তার নৃশংস আকাশযুদ্ধের একটি নিয়মিত অংশ হয়ে উঠেছে।
প্যারামোটর মূলত একটি মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার, যা একজন পাইলট পরিচালনা করেন। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি প্যারামোটর গড়ে ১৬০ কেজি ওজন বহন করতে পারে। অর্থাৎ, একজন চালকের পাশাপাশি এটি ১৬ কেজি ওজনের বেশ কয়েকটি বোমা বহন করতে সক্ষম।
ছোট আকৃতি ও কম উচ্চতায় উড়তে পারার কারণে এটি প্রচলিত যুদ্ধবিমানের চেয়ে লক্ষ্যের অনেক কাছাকাছি যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিপিএস-সজ্জিত এই যান ১হাজার ফুটেরও কম উচ্চতা থেকে নির্ভুলভাবে হামলা চালাতে পারে এবং সাধারণ জ্বালানিতে প্রায় তিন ঘণ্টা উড়তে সক্ষম।
কেন এই সাশ্রয়ী আকাশযুদ্ধ
সামরিক সূত্র বলছে, যুদ্ধবিমানের পাইলট প্রশিক্ষণে কয়েক বছর লাগলেও প্যারামোটর চালক তৈরি করতে মাত্র কয়েক দিনই যথেষ্ট। এর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও অনেক কম।
মূলত একারণেই জান্তা বাহিনীর কাছে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ধারণা করা হয়, মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত একটি কারখানাতেই এই প্যারামোটর তৈরি করা হচ্ছে।
তবে এর কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। কম উচ্চতায় ওড়ার কারণে ভূমি থেকে ছোড়া গুলিতে এটি ভূপাতিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই হামলাগুলো মূলত রাতেই চালানো হয়।
এর ইঞ্জিনের শব্দও তীব্র, যা অনেকটা করাতকলের মতো শোনায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। ফলে মানুষ আগে থেকেই এর উপস্থিতি টের পেয়ে যায়।
বেসামরিক নাগরিকেরাই লক্ষ্যবস্তু
সোমবারের হামলাটি সবচেয়ে প্রাণঘাতী হলেও এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০২৪ সালের বড়দিনে প্রতিরোধ বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মায়িংগিয়ান জেলায় প্রথম প্যারামোটর হামলা চালানো হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতেই এ ধরনের আটটি হামলায় নয়জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাকলেড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় চার বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে জান্তার বিমানবহর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তারা এখন কম খরচের বিকল্পের দিকে ঝুঁকছে। মিয়ানমার ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির মিন জাও উ বলেন, 'এটি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানের মধ্যকার শূন্যস্থান পূরণ করছে। বিমান হারানো এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতার মুখে কম খরচে আকাশে আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল নিয়েছে জান্তা।'
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে হাজার হাজার মানুষ নিহত এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যদিও জান্তা বিদ্রোহীদের কাছে বিশাল এলাকা হারিয়েছে, তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীন থেকে পাওয়া অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় তারা বিমান হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে।
একদিকে চীন জান্তাকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে সীমান্তে বিদ্রোহীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য।
এই বহুমুখী চাপের মুখে বিদ্রোহীরা দুর্বল হয়ে পড়লেও সংঘাতের মধ্যে প্যারামোটর দিয়ে চালানো সন্ত্রাসের নতুন ঢেউয়ে সাধারণ বেসামরিক মানুষকেই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।