প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেমিকের বাবা, হ্যারোডসের মালিক, ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা কে এই আল-ফায়েদ?

কেট (ছদ্মনাম) এর বয়স তখন মাত্র ১৬। বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হ্যারোডসে সবে কাজ শুরু করেছেন। একদিন ডাক পড়ল মালিক মোহাম্মদ আল-ফায়েদের অ্যাপার্টমেন্টে।
সেই রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে কেট বলেন, 'তিনি আমাকে বারবার তার সঙ্গে যৌন মিলনের জন্য চাপ দিতে থাকেন, আমি বারবার 'না' করা সত্ত্বেও।' এরপরই হ্যারোডসের এই সাবেক মালিকের মেজাজ বদলে যায় এবং শুরু হয় হুমকি-ধামকি। কেট বলেন, 'এক পর্যায়ে এসে তিনি প্রচন্ড রেগে যান, দরজাগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি বের হতে পারছিলাম না। এরপর তিনি আমাকে ধর্ষণ করেন!'
কেট একা নন, তার মতো বহু নারী কর্মীদের অভিযোগ, হ্যারোডসে চাকরিরত অবস্থায় আল-ফায়েদের যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল তাদের।
সম্প্রতি সাবেক মালিক মোহাম্মদ আল-ফায়েদের বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঐতিহাসিক অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি একটি তহবিল গঠন করেছে হ্যারোডস। চলতি বছরের মার্চ মাসে চালু হওয়া এই ক্ষতিপূরণ কর্মসূচির আওতায় শতাধিক ভুক্তভোগী আবেদন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালে মারা যাওয়া মোহাম্মদ আল-ফায়েদ ১৯৮৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হ্যারোডসের মালিক ছিলেন। তার মালিকানাকালে একাধিক নারী কর্মী অভিযোগ করেন, তারা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আল-ফায়েদের বিরুদ্ধে চলমান তদন্তে এ পর্যন্ত ১৪৬ জন অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
এই কেলেঙ্কারির নিষ্পত্তিতে নেওয়া পদক্ষেপের সরাসরি প্রভাব পড়েছে কোম্পানির আর্থিক হিসাবে। সর্বশেষ অর্থবছরে হ্যারোডস ৩ কোটি ৪৩ লাখ পাউন্ড লোকসান গুনেছে, যেখানে আগের বছর প্রতিষ্ঠানটির লাভ ছিল ১১ কোটি ১০ লাখ পাউন্ড।

মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করা মোহাম্মদ আল-ফায়েদ কোমল পানীয় বিক্রির মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে আবাসন, জাহাজ ও নির্মাণকাজের ব্যবসায় বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হন।
হ্যারোডস, ফুলহ্যাম ফুটবল ক্লাব ও প্যারিসের রিটজ হোটেলের মতো প্রতিষ্ঠান কিনলেও ব্রিটেনে তাকে বরাবরই 'বহিরাগত' হিসেবে দেখা হতো। কয়েক দশক ধরে ব্রিটেনে বসবাস করেও তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাননি।
তবে বিশ্বজুড়ে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল প্রিন্সেস ডায়ানার প্রেমিক দোদি ফায়েদের বাবা হিসেবে। ১৯৯৭ সালে প্যারিসে সড়ক দুর্ঘটনায় ডায়ানা ও দোদির মৃত্যুর পর তিনি এর পেছনে রাজপরিবারের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন।
কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তিনি দাবি করতেন, ডায়ানার গর্ভে দোদির সন্তান ছিল এবং প্রিন্স ফিলিপ ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে তাদের হত্যা করিয়েছেন। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রমাণে তিনি জীবনের দশটি বছর ব্যয় করেন।
আল-ফায়েদ মারা যাওয়ার পর ভুক্তভোগীদের ভাষ্য এবং বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে আসে, আল-ফায়েদের এই নিপীড়ন চালানোর জন্য হ্যারোডসের ভেতরেই একটি চক্র তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে চিকিৎসক থেকে শুরু করে নিরাপত্তাকর্মী পর্যন্ত সবাই যুক্ত ছিলেন।
কেট জানান, চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর তাকে কোম্পানির স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য হার্লি স্ট্রিটের ডা. অ্যান কক্সনের কাছে যেতে বলা হয়। সেখানে তার 'অন্তরঙ্গ ডাক্তারি পরীক্ষা' করা হয়। কেটের ভাষ্যমতে, 'আমি তাকে জানাই যে আমি এখনো যৌনভাবে সক্রিয় হইনি, তাই এর কোনো প্রয়োজন নেই।' কিন্তু তার আপত্তিকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে অফিসে ফিরলে ফায়েদ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার অন্তরঙ্গ বিবরণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। কেট বিশ্বাস করেন, এই ব্যক্তিগত তথ্যই ফায়েদকে পরবর্তীতে তাকে ধর্ষণ করতে সহায়তা করেছিল।
ভুক্তভোগীদের অনেকেই জানান, ফায়েদের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) এই নিপীড়নে মূল ভূমিকা পালন করতেন। ডাক্তারি পরীক্ষার পর এই সহকারীরাই তরুণীদের ফায়েদের অফিসে বা অ্যাপার্টমেন্টে পাঠাতেন। নাটালি নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, 'আমার মনে আছে, পিএ-র ফোনে কল আসত। তারপর তিনি আমাদের দিকে ঘুরে একজনকে ইশারা করে অ্যাপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিতেন।'
ফায়েদ সব সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী দ্বারা সুরক্ষিত থাকতেন। স্টিভ নামে ফায়েদের এক সাবেক নিরাপত্তাকর্মী জানান, কন্ট্রোল রুম থেকে তারা শুধু দেখতেন মেয়েরা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকছে এবং দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুধু নীরব সাক্ষীই নয়, হ্যারডসের তৎকালীন নিরাপত্তা প্রধান এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জন ম্যাকনামারার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক নারীকে মুখ না খোলার জন্য সরাসরি হুমকি দিয়েছিলেন।
ফায়েদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ধামাচাপা দিতে এবং প্রমাণ ধ্বংস করতেও কাজ করত একটি পক্ষ। ১৯৯৫ সালে 'ভ্যানিটি ফেয়ার' ম্যাগাজিন ফায়েদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তিনি মানহানির মামলা করেন। পরে মামলাটি এই শর্তে নিষ্পত্তি হয় যে, ম্যাগাজিনটি তাদের সমস্ত প্রমাণ ধ্বংস করে ফেলবে।
একইভাবে, ২০০৭ সালে ফায়েদের ব্যক্তিগত সহকারী গেমা ফায়েদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে রেকর্ড করা টেপ নিষ্পত্তির অংশ হিসেবে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়।
এইসব ঘটনা বেরিয়ে আসার পর হ্যারোডসের তৎকালীন ব্যবস্থাপনার দিকে অনেক প্রশ্ন ওঠে। এতদিন ধরে চলা এই নিপীড়নের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কতটুকু জানতেন এবং জেনে থাকলে কেন কোনো পদক্ষেপ নেননি, সেই প্রশ্নও ওঠে।
ক্ষতিপূরণ কর্মসূচির আওতায়, প্রত্যেক যোগ্য আবেদনকারী সাধারণ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ লাখ পাউন্ড পাবেন। তবে কোনো ভুক্তভোগী যদি বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে সম্মত হন, তবে তিনি চিকিৎসা খরচসহ সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৮৫ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত পেতে পারেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়া ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দেড় লাখ পাউন্ড।
তবে এই ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করলে ভুক্তভোগীরা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আর কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য হতে হলে আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি যৌন নিপীড়ন বা অন্যায়মূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষার শিকার হয়েছিলেন এবং এর জন্য হ্যারোডস কর্তৃপক্ষ দায়ী।
কর্মসূচিটি চালুর সময় এক বিবৃতিতে হ্যারোডস বলে, 'অতীতকে যদিও আমরা বদলাতে পারব না, কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা সঠিক কাজটি করতে বদ্ধপরিকর। আমরা আজকের মূল্যবোধ দিয়ে চালিত হতে চাই এবং নিশ্চিত করতে চাই যে ভবিষ্যতে এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।'
হ্যারডস জানায়, তারা স্বীকার করে যে সেই সময়ে 'প্রতিষ্ঠানটি তার নারী কর্মীদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং এর জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।' তারা আরও জানায়, 'আজকের হ্যারোডস, ফায়েদের মালিকানাধীন হ্যারডসের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠান।'