ধর্ষণ বাড়ছে উদ্বেগজনভাবে, অথচ দায়িত্ব নিচ্ছে না রাষ্ট্র

এত উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও কষ্ট বয়ে বেড়াতে পারছি না। প্রতিদিন গণমাধ্যমে উঠে আসছে নারী ও শিশু ধর্ষণের খবর। বিষয়টা এখন আর স্বাভাবিক মাত্রায় নেই, চরম আকার ধারণ করেছে।
বারবার মনে মনে ভাবছি এইসব খবর নিয়ে মাথা ঘামাব না, কষ্ট পাবো না। কিন্তু কীভাবে ভুলে যাব ময়না, আছিয়া, মুরাদনগর আর ভোলার সেই নারীদের কথা। কীভাবে ভুলে যাই পঞ্চগড়ের সেই মায়ের কথা, যাকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল তার দু'বছরের ছেলের মাথায় ছুড়ি ধরে।
এই লেখা লিখতে লিখতেই খবর পেলাম কুলাউড়া জংশনে একজন কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বগুড়ায় গৃহবধূকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। দিনাজপুরে এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়ে লজ্জায় আত্মহত্যা করেছেন।
এই চিত্রেরই পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তাদের জুলাই প্রতিবেদনে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৮১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে, এর মধ্যে শিশু ৩৪৫ জন। ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন। এর মধ্যে ১৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
২০২৪ এর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫১৬টি ছিল ধর্ষণের ঘটনা। শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৬৭টি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৫টি পত্রিকার খবর সংকলন করে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের এসব তথ্য প্রকাশ করেছে।
এ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের খবর প্রায় সমান সমান। সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের পর সবচেয়ে বেশি খবর প্রকাশিত হয়েছে হত্যার।
প্রকাশিত খবর অনুসারে, ৩২০ জন নারী ও কন্যাশিশু হত্যার শিকার হয়েছেন। ৫১ জন যৌন নিপীড়ন ও ৩৪ জন উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমে সহিংসতার সব খবর প্রকাশিত হয় না। প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি। এখন আরও নতুন নতুন ধরন ও মাত্রা নিয়ে নারী নির্যাতন হচ্ছে। সমাজে নারী বিদ্বেষ আগেও ছিল; কিন্তু এখন সেটা মাত্রা ছাড়া হয়ে গেছে।
পাশাপাশি চলছে ভিক্টিম ব্লেইমিং। যে নারী বা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তাকেই নানাধরণের কুযুক্তি দিয়ে দায়ী করা হচ্ছে।
সহিংসতার ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখা হচ্ছে। নির্যাতনের আসল ঘটনা ছাপিয়ে রাজনীতিই সেখানে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে রাষ্ট্র সেখানে ভিক্টিমকে সহায়তা দেওয়ার জন্য কোন ভূমিকা পালন করছে না।
ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে কেন ঘরে-বাইরে বঞ্চনা সহ্য করতে হচ্ছে? যে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তার পরিবার তাকে নিয়ে চরম অনিরাপত্তা ও নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েন। এমন প্রায়ই হয় মামলা তুলে নেওয়ার জন্য বা মামলা না করার জন্য ভয়ভীতি ও চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই চাপ এতো বেশি মাত্রায় হয় যে মাঝেমাঝে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়।
মুরাদনগরের ঘটনার সময় দেখা গেছে যারা সেখানে উপস্থিত হয়েছে, তারা নারীকেই অভিযুক্ত করে মারধর করে। এমনকি ওই নারীর বিবস্ত্র ছবি তুলে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। অথচ যে ধর্ষণ করল, তার ভিডিও কেউ করল না। যদিও এই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পাশাপাশি এই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
মুরাদনগরে ভুক্তভোগীর মায়ের সামনে ওই ঘটনা ঘটে।
তিনি বলেন, এখন আমরা বিচার চাই। 'বদনাম না এইডা? এতে তো মইরা যাওনের কথা। এই দুনিয়ায় না থাইকা তো মইরা যাওনের কথা। মুখ দেহানোর কথা?'
বিভিন্ন গণমাধ্যমের চাপে ওই নারী বাড়ি ছেড়ে অজ্ঞাতস্থানে চলে গেছেন। ভুক্তভোগীকে তার পরিবার বলেছে 'দেশে শান্তির জন্য' এই মামলা না চালিয়ে অন্যত্র চলে যেতে। যদিও উনি মামলা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
কুমিল্লার মুরাদনগরের পরিবারটি সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিজের কনভেনর লাকী বাছাড়।
তিনি বলেছেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিষয়গুলো আমরা দেখতে পেলাম, সেটা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং ঘটনাটা আমাদের সংখ্যালঘুদের জন্য খুব দুঃখজনক। আমরা আরও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি দিনে দিনে।'
লাকী বাছাড় জানান, 'বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে তাদের হিসাব হলো কুমিল্লায় এ বছর মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে অন্তত ১২টি ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। এছাড়া ৫ আগস্টের পর থেকে ৩০০টি ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।'
তিনি আরও বলনন, 'অধিকাংশ থানা থেকে যখন আমরা সঠিক তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করছি, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হচ্ছে প্রশাসনের কিছুটা নেগলিজেন্সি আছে।' [বিবিসি বাংলা]
সাধারণত ধর্ষকের সঙ্গে স্থানীয় নেতা, পলিটিক্যাল পার্টি বা মাস্তানদের যোগাযোগ থাকে। ফলে ধর্ষক ধর্ষণের শিকার মেয়ে ও তার পরিবারের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী থাকে।
শুধু তাই নয়, ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে আদালতে বিচার পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার নারীকে দফায় দফায় হেনস্থা হতে হয় নানাভাবে। তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় তার ধর্ষণের কথা। এমনকি আদালতের জিজ্ঞাসাবাদে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা।
ধর্ষণের শিকার একজন নারী একবার বলেছিলেন, এলাকার লোকজন এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় তারা চোখ দিয়ে পুনরায় ধর্ষণ করছে। নানান প্রশ্ন করে, এমনকি নারী পাড়া-প্রতিবেশিরা জানতে চেয়েছেন তার অনুভূতি কেমন ছিল। কী ভয়াবহ অসুস্থ মানসিকতা আমাদের!
৯ দিনে দেশে ২৪ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
তিনি বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন মহামারির মতো অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এটা চলছে। এর কারণ রাজনীতি, মাদক, মোবাইল ও পর্নোগ্রাফি। একজন ৬০ বছরের বৃদ্ধ একজন শিশুকে ধর্ষণ করেছে।
উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ আরও বলেন, 'এমন অবস্থা যে, আমি এখন এদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে, যদিও আমি মানবাধিকার কর্মী। দেশের মাদ্রাসাগুলোতেও শিশুদের যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। মাদ্রাসাগুলো চোখের আড়ালে থাকে। তথ্য পাই না। সেখানে অনেক শিশু নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।'
উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদের এই কথাগুলো আলোচনার দাবি রাখে। অপরাধ কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একজন মানবাধিকারকর্মী মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে কথা বলছেন।
পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করছেন মানবাধিকারকর্মী ও নারী অধিকার আন্দোলনকারীরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে।
মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলীর পর্যবেক্ষণে ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় খারাপ। [বিবিসি বাংলা]
মহিলা ও শিশু উপদেষ্টার কথার সূত্র ধরেই বলতে চাই, বাংলাদেশে ছেলেরা; বিশেষ করে ছেলেশিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অনেকাংশেই উপেক্ষিত থাকে পুরুষদের প্রতি যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনাগুলো।
অথচ মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, গত দুই বছরে শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়সী ১১১ জন ছেলে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে মামলা করা হয়েছে কেবল ৫৫টি। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার নানা তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলেও, পুরুষদের ক্ষেত্রে খুব কম সময়ই তা পাওয়া যায়।
অনেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তারা মেনেই নিতে পারে না যে ছেলেরা যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, 'বাংলাদেশের আইনেও ছেলেশিশু ধর্ষণ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। 'কোনো ছেলে যদি ধর্ষণের শিকার হন, তার জন্য আইনে কোনো প্রভিশনই (বিধান) নেই। কেননা ছেলেদের ধর্ষণের বিষয়টা আইনে কখনও চিন্তাই করা হয়নি।'
নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে ২০০০ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে শুরুতে কেবল নারী ও ১৬ বছর বয়সের কম বয়সী মেয়ে শিশুদের কথা বলা হলেও হাইকোর্টের এক আদেশের পর ছেলে শিশুদেরও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ, ১৬ বছরের বেশি বয়সী কোনো ছেলে ধর্ষণের শিকার হলেও প্রচলিত আইনে তা বিচারের কোনো সুযোগ নেই।
সেক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী মামলা রজু করতে হয়। আইনের এই ধারায় আন-ন্যাচারাল অফেন্স বা প্রকৃতি বিরুদ্ধ অপরাধের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। [বিবিসি বাংলা]
ছেলেশিশুদের নিরাপত্তার খাতিরেই ছেলেশিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ বিষয়টিকে আমলে আনতে হবে। এখানে লজ্জা, সামাজিক সম্মানহানি, ধর্ম, পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্মান এগুলো নিয়ে ভেবে অপরাধ লুকানোর কোন স্কোপ নাই।
অনেক নারী অধিকারকর্মী মনেকরেন বাংলাদেশের সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী নেতিবাচক এবং গত ৯ মাসে তা বেড়েছে। কট্টরবাদীরা নারীকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। মেয়েরা যেন ভয় পায়, বাইরে কম বের হয়, আধুনিক পোশাক না পরে, নিজের মতামত প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা না করে, রাতে বেড়ানো বন্ধ করে, বোরকা ছাড়া বের না হয় এসবই তারা চায়। এজন্যই নারীর ওপর হামলা করে পরিবেশ তৈরি করছে।
আর নারী অবমাননাকারীর কোনো বিচার হচ্ছে। বরং ফুলের মালা দিয়ে মুক্ত করে আনা হচ্ছে। তাহলে আর অপরাধ কমবে কীভাবে?
আমরা মানি কী না মানি, দেশে ধর্ষণ বাড়ছে। সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা অবশ্য বলেছেন, যেকোনো ফর্মে ধর্ষণকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। আমরা এই আইনে বিধান করেছি ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই আদালত যদি মনে করে মেডিকেল সার্টিফিকেট এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার সম্ভব, তাহলে আদালত ডিএনএ সার্টিফিকেট ছাড়াই মামলা দ্রুত বিচার করবে।
এছাড়া আমরা ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা করেছি। আগের আইনে ১৮০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচারকাজ শেষ করার বিধান ছিল। সেটি কমিয়ে ৯০ দিন করা হয়েছে। আর ১৫ দিনের তদন্ত কাজ শেষ করার বিধানও করেছে সরকার।
এইসব বিধান ভাল ফল বয়ে আনবে তখনই, যখন এগুলো কার্যকর করা হবে। তবে আমরা চাই বিচারের আগে ধর্ষণের মহামারি বন্ধ হোক।
লেখক- যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক