নেপালে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো ম্যান্ডেট অন্তর্বর্তী সরকারের নেই: প্রধানমন্ত্রী কার্কি

আগামী নির্বাচনে সরাসরি নির্বাচিত নির্বাহী প্রধানের দাবিতে জেন-জিদের একাংশ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী সুশিলা কার্কি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়টি তার সরকারের এখতিয়ারভুক্ত নয়।
তিনি বলেন, শুধু সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেই শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব, আর সে ক্ষেত্রে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, 'জেন জি আন্দোলনের সময় উত্থাপিত বিষয়গুলো—যেমন সংবিধান সংশোধন ও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি— বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তাই আমি পরিবর্তনের পক্ষে থাকা তরুণ ও নাগরিকদের আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন নির্বাচনে অংশ নেয় এবং সাংবিধানিক পদ্ধতির মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনে।'
জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সুশিলা কার্কি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে ২০২৬ সালের ৫ মার্চ নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন করাই তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
বর্তমানে নেপাল একটি সংসদীয় ব্যবস্থা অনুসরণ করে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করা হয়। সরাসরি নির্বাচিত নির্বাহী প্রধান পেতে হলে নেপালের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ ধরনের সংশোধনের জন্য কেন্দ্রীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন।
বর্তমানে প্রতিনিধি পরিষদ বিলুপ্ত থাকায় আগামী বছরের ৫ মার্চের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন সম্ভব নয়।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন নাগরিক সমাজ সংগঠনও সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, 'অবৈধ প্রক্রিয়ায়' সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করা উচিত হবে না।
তবে জেন-জি তরুণদের অবস্থানে একতা নেই। একাংশের দাবি, মার্চের নির্বাচনের আগেই শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা উচিত। অন্যদিকে আরেকটি অংশের মতে, সংবিধান সংশোধন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নতুন সংসদের।
জেন-জি নেতা রক্ষ্যা বাম বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী সঠিক বলেছেন—এই সরকার শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না এবং নেওয়াও উচিত নয়। প্রয়োজনে নতুন সংসদই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনবে।'
তিনি আরও বলেন, 'শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের তদন্ত, দুর্নীতি হ্রাস এবং নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজন—এই তিনটি বিষয়ই বর্তমান সরকারের মূল দায়িত্ব।'
আরেক জেন জি নেতা ইউজন রাজভান্ডারি রক্ষ্যা বামের মতের প্রতি সহমত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা করা মানে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেওয়া। এতে নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশ আরও সংঘাতের দিকে যেতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'সংবিধান সংশোধনের যে কোনো উদ্যোগ কেবল বৈধ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই নেওয়া উচিত।'
আন্দোলনকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী কার্কি যুব আন্দোলনকারীদের হত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর জেন জেড আন্দোলনের প্রথম দিনেই ১৯ তরুণ নিহত হন এবং শত শত মানুষ আহত হন।
মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪-এ, আর ডজনখানেক আহত এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস এবং সহিংসতার তদন্তে সরকার ইতোমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন বিশেষ আদালতের সাবেক একজন চেয়ারম্যান।
নিজের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী কার্কি বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। ভোটার নিবন্ধন আইন সংশোধনের জন্য অধ্যাদেশ জারির পর নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার নিবন্ধন পুনরায় শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সকল যোগ্য নেপালি নাগরিক আগামী নভেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, 'বিদেশে কর্মরত নেপালি নাগরিকদের প্রবাস থেকেই ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।'
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'আসন্ন প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনে সবাই যেন উৎসাহের সঙ্গে অংশ নেয় এবং যোগ্য প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে।'
কার্কি আরও বলেন, ছয় মাস মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুধু নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে—তাই জেন জি আন্দোলনের সব দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। তবুও তার সরকার এখতিয়ারসীমার মধ্যে থেকে যথাসাধ্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাবে।
তিনি আরও বলেন, তার সরকার নাগরিকদের যেন হয়রানি, অযথা বিলম্ব বা ঘুষের প্রয়োজন ছাড়াই সরকারি সেবা গ্রহণের সুযোগ পায়—তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'আমরা চাই দক্ষ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দ্রুত, সম্মানজনক ও হয়রানিমুক্তভাবে সেবা নিশ্চিত করতে।'
কার্কি জানান, তার সরকার দুর্নীতি হ্রাস, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
তিনি আরও বলেন, 'যদি কোথাও অবহেলা, সেবা প্রদানে দরকষাকষি, কাজ ফেলে রাখা, ঘুষ দাবি, অযথা হয়রানি বা সেবা গ্রহণকারীর সঙ্গে অশোভন আচরণের ঘটনা ঘটে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্য একটি ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে।'
দেশ কঠিন সময় অতিক্রম করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সুশিলা কার্কি সব নেপালি নাগরিককে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, 'এই সংকটময় সময়ে আমার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়িত্ব পালনে সহায়তা করতে সব দেশপ্রেমিক নেপালির পূর্ণ সমর্থন প্রত্যাশা করছি।'
কার্কি জোর দিয়ে বলেন, জেন জি আন্দোলনের উত্থাপিত দাবিগুলো বর্তমান সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই সমাধান করতে হবে। বর্তমান সংবিধান একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিতে গঠিত।
তিনি আরও বলেন, 'অতীতের আন্দোলন, ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সাফল্যগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং বর্তমান জেন জেড আন্দোলনের উত্থাপিত দাবিগুলোর প্রতিক্রিয়া জানাতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।'