লতা মঙ্গেশকরের অনুপ্রেরণা ছিলেন এই কিংবদন্তি পাকিস্তানি শিল্পী, গেয়েছেন ১০ হাজারের বেশি গান

উপমহাদেশের সঙ্গীতের সোনালি ইতিহাসে যে কজন শিল্পী কিংবদন্তি হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে তার নাম জ্বলজ্বল করছে এক বিশেষ উজ্জ্বলতায়। তার জাদুকরি কণ্ঠের ভক্ত ছিলেন কোটি কোটি মানুষ, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন স্বয়ং ভারতের সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর।
তিনি নূরজাহান। লোকে ভালোবেসে তাকে ডাকত 'মালিকা-এ-তারান্নুম' বা 'সুরের রানি' বলে।
কয়েক দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় ১০ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। 'আনমোল ঘড়ি' সিনেমার 'আওয়াজ দে কাহা হ্যায়'-এর মতো গানগুলো যেন দেশের সীমানা পেরিয়ে আজও অমলিন। তার কণ্ঠের মাধুর্য, গভীরতা আর আবেগের সেই নিখুঁত মিশ্রণ আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে দোলা দেয়।
তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্তের মধ্যে একজন ছিলেন ভারতের 'স্বর কোকিলা' লতা মঙ্গেশকর, যিনি প্রায়শই নূরজাহানের গায়কী দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা বলতেন।
যেভাবে নূরজাহানের পথচলার শুরু
১৯২৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পাঞ্জাবের কাসুরে (বর্তমানে পাকিস্তানে) জন্মগ্রহণ করেন নূরজাহান। তার আসল নাম ছিল আল্লাহ রাখি ওয়াসাই। খুব অল্প বয়স থেকেই সংগীতে তার অসাধারণ প্রতিভা প্রকাশ পায়।
শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়ার পাশাপাশি তিনি মঞ্চেও গান পরিবেশন শুরু করেন। তার জাদুকরি কণ্ঠ দ্রুতই তাকে 'মালিকা-এ-তারান্নুম' উপাধি এনে দেয়।
তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল অবিভক্ত ভারতে। হিন্দি সিনেমায় একাধারে অভিনেত্রী ও শিল্পী হিসেবে কাজ করে দ্রুতই তারকাখ্যাতি পান। 'আনমোল ঘড়ি', 'জুগনু' বা 'মির্জা সাহিবা'র মতো সিনেমা তাকে দেশভাগের আগেই শীর্ষ তারকার আসনে বসিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে শুধু শিল্পী হিসেবেই নয়, পাকিস্তানের প্রথম নারী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে গড়েন নতুন ইতিহাস।

নূরজাহান কেবল একজন শিল্পীই ছিলেন না; তিনি ছিলেন সাহসী, স্বাধীন এবং আপসহীন এক ব্যক্তিত্ব। তিনি দুবার বিয়ে করেছেন, সন্তানদের লালন-পালন করেছেন এবং সঙ্গীতের দীর্ঘ যাত্রাপথের পাশাপাশি পারিবারিক জীবনের দায়িত্বও সামলেছেন সমান তালে। তার সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব এবং আত্মবিশ্বাস তাকে এমন এক সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত করেছিল, যিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে ছিলেন আরাধ্য।
নূরজাহান ও লতা মঙ্গেশকরের বন্ধুত্বের গল্প উপমহাদেশের সঙ্গীতের অন্যতম এক অধ্যায়। লতা যখন তার ক্যারিয়ার সবে শুরু করেছেন, তখন নূরজাহান ছিলেন তার অনুপ্রেরণার বাতিঘর। তিনি প্রায়ই লতাকে উৎসাহ দিতেন এবং ভালোবেসে ডাকতেন 'লাড্ডু' বলে।
দেশভাগ তাদের ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন করলেও তাদের হৃদয়ের বন্ধন অটুট ছিল। ১৯৫১ সালে সংগীত পরিচালক সি. রামচন্দ্র তাদের নিয়ে একটি দ্বৈত গান রেকর্ড করার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেই উদ্যোগ সফল হয়নি, তবে দুই শিল্পী আত্তারি সীমান্তে কিছুক্ষণের জন্য দেখা করেছিলেন।
রামচন্দ্রের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, দেখা হতেই তারা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। এই আবেগঘন মুহূর্তটিই যেন মনে করিয়ে দেয়—সীমান্ত দেশকে ভাগ করতে পারলেও হৃদয়কে পারে না।
নূরজাহানের বন্ধুত্বের পরিধি ছিল বিশাল। অভিনেতা ধর্মেন্দ্রসহ চলচ্চিত্র জগতের অনেকের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধিসহ বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন, যা তার বহুমুখী প্রতিভার প্রমাণ। উঁচু বা নিচু—যেকোনো স্কেলে তার অনায়াস বিচরণ শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার, যেমন 'প্রাইড অব পারফরম্যান্স' এবং 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ'-এ ভূষিত হন।
২০০০ সালের ২৩ ডিসেম্বর করাচিতে এই কিংবদন্তি শিল্পী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার জানাজায় নেমেছিল মানুষের ঢল। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার কণ্ঠ আজও বেঁচে আছে—রেকর্ডিংয়ে, চলচ্চিত্রে এবং ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গীতপ্রেমীদের সম্মিলিত স্মৃতিতে।
যেমনটা তার এক ভক্ত একবার বলেছিলেন, 'তিনি তাঁর গানের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকবেন, কারণ তার মতো কণ্ঠের কখনও মৃত্যু হয় না।'