কেন ‘ওয়ান পিস’ অ্যানিমের বিখ্যাত জলদস্যু পতাকা হাতে রাজপথে ‘জেন জি’রা

গত সপ্তাহে যখন নেপালের বিখ্যাত সিংহ দরবার প্রাসাদ আগুনে জ্বলছিল, ঠিক তখনই দেশটির সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া বিক্ষোভকারীরা প্রাসাদের কারুকার্যখচিত সোনালি ফটকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল একটি পতাকা।
সাদা খুলির ওপর খড়ের টুপি আঁকা এই অদ্ভুত পতাকা কোনো রাজনৈতিক দল বা বার্তার নয়, এটি বিশ্বখ্যাত জাপানি মাঙ্গা (কমিকস) সিরিজ 'ওয়ান পিস'-এর জলদস্যুদের পতাকা।
একটি ঐতিহাসিক সরকারি ভবনের সামনে কার্টুনের পতাকা ঝোলানোর দৃশ্যটি অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কিন্তু নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসা 'জেন জি' প্রজন্মের তরুণ বিক্ষোভকারীদের কাছে এর অর্থ ছিল গভীর। টানা দুই দিনের এই অস্থিরতায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।
পতাকাটি ১৯৯৭ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসা বিশ্ববিখ্যাত জাপানি মাঙ্গা বা গ্রাফিক নভেল 'ওয়ান পিস' থেকে নেয়া। 'ওয়ান পিস'-এর গল্প জলদস্যু ক্যাপ্টেন মাঙ্কি ডি. লুফি এবং তার 'খড়ের টুপি' পরা সঙ্গীদের দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে। ভক্তদের কাছে এই পতাকাটি স্বপ্নকে তাড়া করা, নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করা আর স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা। গল্পের নায়ক লুফি নির্ভীক, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং চরম প্রতিকূলতার মাঝেও হাসতে জানে।
কিন্তু গল্পের জগৎ ছাড়িয়ে লুফির এই পতাকা এখন ভাষা ও সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন থেকে শুরু করে ফ্রান্সের রাজপথেও তরুণদের প্রতিবাদের এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

নেপালের বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক বিখ্যাত খাত্রী বলেন, 'এই পতাকাটি আগ্রাসন এবং পথে আসা যেকোনো বাধা ঠেলে দেওয়ার দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। নেপালের বহু তরুণ অ্যানিমে ভালোবাসে। আমরা চেয়েছিলাম এই আন্দোলনটিকে যেন 'জেন জি' প্রজন্মের আন্দোলন বলে মনে হয়। তাই স্লোগান ও প্রতীকগুলো এমনভাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল, যার সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম সহজে নিজেদের যুক্ত করতে পারে।'
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে, 'ওয়ান পিস' একক লেখকের তৈরি কমিক বই সিরিজ হিসেবে সবচেয়ে বেশি কপি প্রকাশের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙেছে। বিশ্বজুড়ে এর ৫০ কোটিরও বেশি কপি ছাপা হয়েছে। এই দীর্ঘস্থায়ী সিরিজকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অ্যানিমে টেলিভিশন সিরিজ, পডকাস্ট এবং অগণিত ফ্যান সাইট। ২০২৩ সালে নেটফ্লিক্স এটিকে একটি লাইভ-অ্যাকশন সিরিজে রূপান্তর করে, যা এর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
আধুনিক জাপানের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেয়া হরবিনস্কি বলছেন, 'ওয়ান পিস'-এর পতাকাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে দেখে তিনি অবাক হননি। তার মতে, 'লুফি খুবই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে এবং তার সঙ্গীরা বহু বাধা পেরিয়ে নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে। মানুষ যখন এই পতাকা নিয়ে বিক্ষোভে নামে, তখন তারা লুফির এই লড়াকু মানসিকতার কথাই ভেবে অনুপ্রাণিত হয়।'

বাস্তব এবং ডিজিটাল জগতের এই মেলবন্ধনে পপ সংস্কৃতির নানা চরিত্র ও প্রতীক প্রায়শই বিক্ষোভকারীদের প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
ডানপন্থী অনলাইন মিম 'পেপে দ্য ফ্রগ' ২০১৯ সালে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। আবার, 'হাঙ্গার গেমস' সিনেমার তিন আঙুলের স্যালুট থাইল্যান্ডের গণতন্ত্রপন্থী তরুণ এবং মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধীদের কাছে প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
নেপালে বিক্ষোভকারীরা রাজনীতিবিদদের সন্তানদের সামাজিক মাধ্যমে বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রদর্শনীতে ক্ষুব্ধ হয়ে 'ওয়ান পিস'-এর পতাকার পাশাপাশি 'জেন জি চুপ থাকবে না,' 'তোমাদের বিলাসিতা, আমাদের দুর্দশা!' এবং 'নেপো বেবি'র মতো স্লোগানও ব্যবহার করে।

যদিও ইন্দোনেশিয়ায় এই পতাকা বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা দিবসের আগে তরুণরা এটি ওড়ালে সরকারি কর্মকর্তারা একে 'রাষ্ট্রদ্রোহিতা'র সঙ্গে তুলনা করেন। কর্তৃপক্ষ পতাকা জব্দ ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলতে শুরু করলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়।
ইন্দোনেশিয়ার শিল্পী কেমাস মুহাম্মদ ফিরদাউস 'স্ট্র হ্যাট' জলদস্যুদের পতাকার একটি দেয়ালচিত্রে শেষ আঁচড় দিতে দিতে বলেন, এই মাঙ্গা অঙ্কনটি 'সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যাতে তারা তাদের জনগণের দিকে তাকায়।'
নিজের হাতে আঁকা জলদস্যু পতাকাটি ধরে ফিরদাউস বলেন, 'বহু ইন্দোনেশীয় নাগরিক 'ওয়ান পিস'-এর পতাকা ওড়াচ্ছে, কারণ তারা চায় সরকার তাদের কথা শুনুক। দিনশেষে, মানুষের এটুকুই আশা, সরকার তাদের চলমান সমস্যাগুলোর সমাধান করবে।'