নেপালের জেন-জি আন্দোলনে জিতল কারা, হারল কারা

৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর একদল নিরীহ তরুণ 'জেন-জি'-এর ব্যানারে নেপালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল। কিন্তু আন্দোলনটি প্রতিহিংসাপরায়ণ বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যক্তির হাতে নির্মমভাবে ছিনতাই হয়ে যায় ও তা নজিরবিহীন অস্থিরতায় পরিণত হয়। এ আন্দোলন নেপালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিয়েছে।
৮ সেপ্টেম্বর আন্দোলনকারীদের দমনে ১৯ তরুণের মৃত্যু হলে এর প্রতিক্রিয়ায় ৯ সেপ্টেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ বিক্ষোভ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে দেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে।
ইতোমধ্যেই দুরবস্থায় থাকা নেপালের অর্থনীতির ওপর এ আন্দোলন ভয়াবহ আঘাত। হিলটন হোটেলসহ বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরাও এতে আতঙ্কিত। তার ওপর অন্তর্বর্তী সরকারকে ছয় মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে!
প্রশ্ন হলো—ধ্বংসস্তূপে পরিণত অবকাঠামো আবার কীভাবে গড়ে তোলা হবে? সেই অর্থ আসবে কোথা থেকে? একই সঙ্গে কীভাবে জনগণের ক্ষোভ-অসন্তোষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে এবং কীভাবে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিগুলোকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে?
কার্কি সরকারসহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের সামনে এখন এগুলোই সবচেয়ে বড় প্রম্ন। নতুন পরিস্থিতির যেমন ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি নেতিবাচক দিকও আছে।
তরুণ রাজনীতিবিদদের জন্য সুখবর
অনেকে মনে করেন, 'জেন জি'-এর নামে হওয়া রক্তাক্ত রাজনৈতিক সহিংসতার পর নেপালের তিন প্রধান রাজনৈতিক দল—নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন-ইউএমএল ও মাওইস্ট সেন্টার—ধসে পড়েছে। তবে আমি এই ধারণার সঙ্গে একমত নই।
তবে নিঃসন্দেহে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ঘটনা ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে ও হতাশ করেছে। তাদের অহংকারও অনেকটাই ভেঙে গেছে। গণতান্ত্রিক মনোভাব থেকে আমি এটিকে ইতিবাচক বলে মনে করি। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছি, যা রাজনৈতিক সংস্কার ও পুনর্জাগরণের জন্য সহায়ক হতে পারে।
একটি বিষয় স্পষ্ট যে বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে এখন সরে দাঁড়াতেই হবে। তাদের অবসরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। বড় দল হোক বা ছোট দল—সব দলের নেতাদের নিজেদের দলের ভেতর থেকেই এখন ভয়াবহ চাপের মুখে পড়তে হবে ক্ষমতা ছেড়ে তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য।
জনগণের হতাশা ও ক্ষোভের একটি বড় কারণ হলো—শীর্ষ নেতাদের আজীবন নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকার মানসিকতা। তারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবসর নিতেন না। ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং সেই ক্ষমতা নিজের সন্তান বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের হাতে তুলে দিতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন।
জেল ভাঙার চেষ্টা চরমভাবে ব্যর্থ
অনেকে মনে করেন, চরম বিতর্কিত নেতা রবি লামিচানে ও তার দল 'রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি (আরএসপি)'-ই মূলত 'জেন জি' আন্দোলনকে বিপথগামী করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ৯ সেপ্টেম্বর বেশ কয়েকজন আরএসপি কর্মীকে সম্পদ ভাঙচুর করতে দেখা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সুযোগ নিয়ে তারা তাদের নেতাকে জেল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল।
প্রতারণা ও সমবায় তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগে লামিচানে বর্তমানে নাখু কারাগারে বন্দি। অভিযোগ আছে, তাকে মুক্ত করে তার অবশিষ্ট জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী বানানোর পরিকল্পনাই ছিল দলের। সত্যিই, দলীয় কর্মীরা ও অন্যরা তাকে কারাগার থেকে বেরও করে এনেছিল—একজন মহান যোদ্ধার মতো—এবং সোজা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসানোর চেষ্টা করেছিল!
কিন্তু বলিউড-ধাঁচের সেই নাটকীয় ঘটনাটি বেশিক্ষণ টেকেনি। 'জেন জি' আন্দোলনকারীরা রবি লামিচানেকে কোনো সমর্থন দেয়নি। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, লামিচানেকে মুক্ত করার কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না, বরং জেল ভাঙার নাটক সাজানোর জন্য তারা আরএসপিকেই দোষারোপ করেছে।
চতুর লামিচানে অবশ্য নিজের মুক্তিকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করেন। তিনি দাবি করেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ধরে রাখতে পারেনি বলেই তিনি মুক্তি পেয়েছেন। এমনকি তিনি একটি আনুষ্ঠানিক নথিও দেখান, যেখানে তার মুক্তিকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন। তবে এখন একাধিক সংবাদমাধ্যম প্রমাণ করেছে, সেই নথি নকল।
অতীতের বেশিরভাগ সময়ের মতো এবার মানুষ রবি লামিচানেকে বিশ্বাস করেনি। আন্দোলনের উত্তাল সময়েও তারা তাকে রাস্তায় নায়ক বানায়নি। বরং, তার মুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়তেই নাখু কারাগার, কেন্দ্রীয় কারাগার ও দেশের বিভিন্ন জেলখানায় অন্যান্য বন্দিদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং কয়েক লক্ষ দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী জেল ভেঙে বেরিয়ে আসে। এতে লামিচানে ও তার দল ভয়াবহভাবে বিব্রত হয়।
ফলে 'জেন জি' আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পরাজিতদের মধ্যে একটি হলো রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি (আরএসপি)। তাদের কৌশলী ও ধূর্ত পরিকল্পনার ফাঁদে উল্টো তারাই পড়েছে। ঘৃণা ও লজ্জায় আরএসপির জনপ্রিয় নেতা এবং সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী সুমনা শ্রেষ্ঠা ইতোমধ্যেই দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
মারাত্মক সহিংস এই আন্দোলন ভারতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিছু সংবাদমাধ্যম নেপালের এই সহিংসতাকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখিয়েছে।
জনগণের একাংশের ধারণা, বিদেশি শক্তি—মূলত ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো—কে.পি. শর্মা ওলিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে চীনের ঘনিষ্ঠ মনে করা হতো। চীন নেপালে আন্তঃহিমালয়ান রেলপথ ও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করছিল।
অবস্থার উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় যখন সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় ওলি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে কাঠমান্ডুতে আমন্ত্রণ জানান। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য রাশিয়ার কাছে এটি বড় সুযোগ বলে ধারণা করা হয়।
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে এখনই প্রমাণ বা খণ্ডন করার কোনো উপায় নেই। আমরা হয়তো কখনোই চূড়ান্ত সত্য জানতে পারব না। সবই শোনা কথা, প্রতিবেশী কিংবা বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর ওপর দোষারোপ করার মতো কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
তবে, যদি এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সামান্যতম সত্যও থাকে—যে ভারত এবং/অথবা পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউএমএল-কংগ্রেস জোটকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা করেছিল—তাহলে তারা জিতেছে। আর হেরেছে চীন—যে শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক শক্তি হিসেবেও দ্রুত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে।
রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ চেষ্টা?
ব্যাপকভাবে মনে করা হয়, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (আরপিপি) এবং আরও কিছু রাজতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠী ও ব্যক্তি, আন্দোলনের এই বিশৃঙ্খলার সুযোগে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। এ ছিল তাদের জন্য এক আদর্শ সুযোগ। কারণ সিংহ দরবার, বালুয়াটার ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় তখন বিক্ষোভকারীদের দখলে ছিল। আর মন্ত্রীরা সেনাবিাহিনীর নিরাপত্তার আড়ালে ছিলেন।
কতটা পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটেছিল, তা আমরা জানি না। তবে রাজতন্ত্রপন্থীরা সত্যিই চেষ্টা করেছিল রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে নারায়ণহিতি প্রাসাদে ফেরাতে। তাদের কাছে এটি ছিল স্বপ্নপূরণের মতো ঘটনা। শোনা যায়, সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে অনুরোধ করেছিলেন, যেন সেনাবাহিনী পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌডেল পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান।
রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পৌডেলের অবিশ্বাস্য সাহসিকতা ও দৃঢ়তা, এমনকি জীবনসংকটের ভয়ঙ্কর সময়েও, আমাদের গণতন্ত্রকে, বহুদলীয় ব্যবস্থা ও প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে—এক কথায় স্বাধীনতাকে—রক্ষা করেছে।
তবু আমরা এখনো পুরো সত্য জানি না। এটি সত্য হোক বা কল্পনা—রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি ও অন্যান্য রাজতন্ত্রপন্থীদের সুনাম ইতোমধ্যেই চূর্ণ-বিচূর্ণ। ভয়াবহ অরাজকতা ও ক্ষমতার শূন্যতাকে কাজে লাগানোর কৌশল তাদের উল্টো ফল দিয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, সব ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষতির মাঝেও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক। গণতন্ত্র টিকে গেছে, কিছু বহুল পরিচিত পপুলিস্ট প্রচারক মুখ থুবড়ে পড়েছে, আর 'মুকুটবিহীন রাজারা' এখন অবসরে গিয়ে নিজেদের দল ও সংগঠনের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখার চাপে আছেন। ফলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের নেতারা দেশের জন্য নতুন আশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।
এটাই 'জেন-জি' নামের এই গণ-আন্দোলনের সম্ভাব্য বড় অর্জন।