ডিসকর্ডেই ভোটাভুটি করে যেভাবে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী বেছে নিল নেপালের ‘জেন-জি’রা

নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন মোড় এসেছে। সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করার পর, দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি।
এই নিয়োগ শুধু নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর খেতাব এনে দেয়নি, বরং এর পেছনে রয়েছে 'জেন জি' প্রজন্মের এক ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক অংশগ্রহণও।
বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়েছিল সাবেক সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাপ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুকসহ ২৬টি অ্যাপ বন্ধ হওয়ার পর নেপালের তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে আসে।
তাদের মূল দাবি ছিল, দেশে বছরের পর বছর ধরে চলা কথিত দুর্নীতির অবসান। অলি সরকারের পতনের পর যখন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ওপর তরুণদের আস্থা শূন্যের কোঠায়, তখন 'জেন জি' তাদের পরবর্তী নেতা নির্বাচনের জন্য এক অভিনব প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকেছে–আর তা হলো অনলাইন চ্যাটিং অ্যাপ 'ডিসকর্ড'।
এই ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মেই 'জেন জি' বিক্ষোভকারীরা একটি অনলাইন ভোটাভুটির আয়োজন করে, যেখানে সুশীলা কার্কি সবচেয়ে পছন্দের প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্র বিমোচন তিমিলসিনা, তরুণ রাজনীতিবিদ সাগর ঢাকাল, ধরান শহরের জনপ্রিয় মেয়র হার্কা সাম্পাং এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গ্রামীণ উন্নয়নে পরিচিত সামাজিক ব্যক্তিত্ব মহাবীর পুনের মতো পরিচিত মুখদের পেছনে ফেলে পছন্দের শীর্ষে উঠে আসেন। এর আগে, তরুণরা র্যাপার থেকে কাঠমান্ডুর মেয়র বনে যাওয়া বালেন শাহকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে সমর্থন করলেও, ডিসকর্ডের ভোটে কার্কিই এগিয়ে আসেন।
২০১৫ সালের মে মাসে জেসন সিট্রন এবং স্ট্যানিস্লাভ ভিশনেভস্কি নামের দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডিসকর্ডকে একটি সামাজিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চালু করেন। মূলত গেমারদের জন্য তৈরি এই অ্যাপটির মূল লক্ষ্য ছিল, গেম খেলার সময় পারফরম্যান্সে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে যোগাযোগের একটি সহজ উপায় তৈরি করা।
২০১৬ সালের শেষের দিকে এর ব্যবহারকারী সংখ্যা আড়াই কোটি ছাড়িয়ে যায়।
তবে মহামারী চলাকালীন, বিশেষ করে 'জেন জি' প্রজন্মের মধ্যে ডিসকর্ডের জনপ্রিয়তা ব্যাপক আকার ধারণ করে। শুধু গেম খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে, বিভিন্ন আগ্রহের বিষয়ভিত্তিক ডিসকর্ড সার্ভার তৈরি হতে থাকে। অ্যাপটি এখন নিজেকে একটি বিস্তৃত যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচয় দেয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা সার্ভারগুলোর মাধ্যমে টেক্সট, অডিও বা ভিডিও চ্যানেলে আলোচনা ও বিতর্কে অংশ নিতে পারেন।
এর বিশাল ধারণক্ষমতা–একটি সার্ভারে ৫ লাখ পর্যন্ত সদস্য এবং আড়াই লাখ সক্রিয় সদস্য থাকার সুযোগ–এটিকে গণআন্দোলনের সময় তথ্য আদান-প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পর, 'ইউথ অ্যাগেইনস্ট করাপশন' নামের ডিসকর্ড সার্ভারের সদস্যরা তাদের পরবর্তী নেতা নির্বাচনের জন্য এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। সার্ভারে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সদস্য রয়েছে। তবে এই সদস্যদের অবস্থান যাচাই করার কোনো নির্দিষ্ট উপায় নেই।
এই সার্ভারটি নেপালের পরবর্তী নেতা নির্বাচনের জন্য একাধিক ভোটাভুটির আয়োজন করে, যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেন। তবে, ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া সব ব্যবহারকারী সত্যিই নেপালের কিনা, তা যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না। নেপালের বাইরের যে কেউ এই ভোটে অংশ নিতে পারতেন।
গত বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) নাগাদ, এই সার্ভারটি নেপালের পরবর্তী নেতার বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছে। ডিসকর্ড সার্ভারটির ভোটে নেপালের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে নির্বাচিত করা হয়। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, কার্কি ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ার আগে ৭ হাজার ৭১৩টি ভোট পড়েছিল। এর পরের দিনই তিনি নেপালের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেল এবং সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগডেলের সঙ্গে দেখা করেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এক চ্যানেল মডারেটর শাস্বত লমিছানে বলেন, এই ভোটাভুটির উদ্দেশ্য ছিল শুধু একটি অন্তর্বর্তীকালীন নেতাকে প্রস্তাব করা, যিনি নির্বাচন তদারকি করতে পারবেন।
সুশীলা কার্কির এই ঐতিহাসিক নিয়োগকে স্বাগত জানালেও কিছু 'জেন জি' প্রতিনিধি তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ডিসকর্ড চ্যাটে থাকা একজন 'জেন জি' সদস্য ভোটাভুটির প্রক্রিয়াটিকে 'ত্রুটিপূর্ণ' উল্লেখ করে জানান, গ্রুপে ৪০ হাজার সদস্য থাকলেও, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার জন্য কার্কি ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ার পরই ভোটাভুটি শেষ হয়ে যায়।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও, কীভাবে আমরা জানব যে তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন? একটি গণশপথ গ্রহণ করতে হবে। এখানে একমাত্র আশার আলো হলো, তিনি তরুণদের মূল দাবিগুলোর সঙ্গে একমত হয়েছেন এবং বালেন শাহের সমর্থন পেয়েছেন।'
সাধারণভাবে, মিলেনিয়াল বা এরও আগের প্রজন্মের অনেকেই ডিসকর্ড সম্পর্কে তেমন পরিচিত নন। তবে, 'জেন জি' এর জন্য এটি একটি সুবিধাজনক এবং আরামদায়ক প্ল্যাটফর্ম।
নেপালের বিক্ষোভকারীরা তাদের আন্দোলনের জন্য অ্যাপটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা পুরোপুরি জানত। এই সার্ভারগুলোতে বিভিন্ন ঘোষণা, ফ্যাক্ট-চেক, মাঠের আপডেট, সংবাদ ডাম্প, প্রশ্ন, জরুরি হেল্পলাইন এবং সাধারণ আলোচনার জন্য আলাদা চ্যানেল রয়েছে। এর ফলে নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা অনেক সহজ হয়।