ট্রাম্পের শুল্কে ভারতীয় রপ্তানি খাতে বিপর্যয়, ঝুঁকিতে লাখো জীবিকা

ভারতের অর্থনীতির বড় একটি অংশ সামনে দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি। ২৭ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া ভারতীয় পণ্যের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা ২৫ শতাংশ শুল্ক দ্বিগুণ হয়ে ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে। এতে টিকে থাকা অনেক ব্যবসা মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে পারে। শুল্ক বাড়ার ফলে বিদেশি অর্ডার বন্ধ হয়ে যাবে, পাশাপাশি কর্মসংস্থান হারাবেন লাখ লাখ খেটে খাওয়া মানুষ।
উত্তরপ্রদেশের ভাদোহির কার্পেট প্রস্তুতকারক ইশতিয়াক আহমেদ খান বলেন, "আমরা ২৫ শতাংশ শুল্কেই হতবাক হয়েছিলাম এবং ভাবছিলাম কীভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করব। কিন্তু এখন এটি ৫০ শতাংশ, এই অবস্থায় ব্যবসা প্রায় অসম্ভব। এদিকে এর ফলে বহু নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা বেকার হয়ে পড়বে।"
ভারতে কার্পেট একটি বড় ব্যবসা। এখানকার ৯৮ শতাংশ কার্পেট বিদেশে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে হাতে তৈরি কার্পেটের বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ৬০ শতাংশ কার্পেট যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। এখন মার্কিন আমদানিকারকদের একটি ৫০০ ডলারের কার্পেটের জন্য ২৫০ ডলার পর্যন্ত শুল্ক দিতে হতে পারে।
ভাদোহি ভারতের কার্পেট শিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে ইশতিয়াকের কোম্পানি 'আজাজ কার্পেটস'-এর মতো শত শত উৎপাদক রয়েছে। এই শুল্কের কারণে তাদের লাভ প্রায় শেষ হয়ে যাবে। ইশতিয়াক আশঙ্কা করছেন, এই অঞ্চলের প্রায় ২৫ লাখ মানুষ চরম দারিদ্রে পড়বে।
একই রকম সংকটে পড়তে যাচ্ছে আরও কয়েকটি শিল্প। এর মধ্যে রয়েছে বস্ত্র ও পোশাক, চিংড়ি চাষ এবং আসবাবপত্র। এই শিল্পগুলো ভারতের সবচেয়ে চাকচিক্যময় ব্যবসা না হলেও, এগুলোর মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আর এসব শিল্প থেকে অর্জিত কোটি কোটি ডলার ভারতের অর্থনীতিকে নানা সংকটের সময়েও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করেছে।
গত বছর ভারত-মার্কিন বাণিজ্য ছিল ১২৯ বিলিয়ন ডলারের। সেই তুলনায় কার্পেট ব্যবসা খুব বড় অংশ না হলেও, এই শুল্ক দুই দেশের মধ্যকার বড় বাণিজ্যিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলছে।
ভারতের ওষুধ শিল্পও একটি বড় উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত জেনেরিক ওষুধের একটি বড় অংশ ভারত সরবরাহ করে। ট্রাম্প প্রশাসন আপাতত ভারতীয় ওষুধের ওপর শুল্ক ছাড় দিলেও, ভবিষ্যতে ১৫০ থেকে ২৫০ শতাংশ শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছে। ট্রাম্পের ধারণা, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের উৎপাদন বাড়বে।

একইভাবে, সেমিকন্ডাক্টরের মতো পণ্যে ছাড় থাকায় ভারতের ইলেক্ট্রনিক্স উৎপাদন শিল্প বাঁচতে পারবে কিনা, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অ্যাপল চীনের বদলে ভারতে আইফোন উৎপাদন শুরু করার পর এই শিল্প বেশ ভালো করছিল।
তেল ও গ্যাসের বিষয়টাও বেশ জটিল। জ্বালানি পণ্য এখনো শুল্কের বাইরে রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প ভারতের রুশ তেল কেনার বিষয়টিকে হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভারতীয় কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনে সেই ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এই শুল্ক বৃদ্ধি দেখে মনে হচ্ছে, এটি ভূ-রাজনৈতিক কারণে হচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল কেনার বিষয়ে ট্রাম্পের অসন্তোষই এর মূল কারণ।
এই শুল্ক ভারতের রত্ন ও গয়না শিল্পেও বড় ক্ষতি করতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় রত্নের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান কিরিট ভানসালি বলেন, এই ব্যাপক শুল্ক এই খাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। এর ফলে তুরস্ক ও থাইল্যান্ডের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো ভারতের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যাবে।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলোকে বাঁচাতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা এখনও দেখা যাচ্ছে না। নয়াদিল্লির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অজয় শ্রীবাস্তব বলেছেন, রাজ্য সরকারগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবসময় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্প্রতি তার এক ভাষণে কঠিন সময়ের কথা উল্লেখ করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, "একটি জাতি অন্যের ওপর যত বেশি নির্ভরশীল হবে, তার স্বাধীনতা তত বেশি প্রশ্নের মুখে পড়বে।"
তবে, যেসব অর্থনীতিবিদরা মুক্ত বাণিজ্যকে ভারতের সমৃদ্ধির সোপান বলে মনে করতেন, তাদের কাছে মোদীর এই বক্তব্য একটি পশ্চাৎপদ পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।
কার্পেট রপ্তানিকারক ইশতিয়াক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুফলের কথা তুলে ধরে বলেন, তার অঞ্চলের ৮০ শতাংশ কর্মীই কৃষক। তারা বছরে বেশিরভাগ সময় ধান, গম ও সবজি চাষ করে। কিন্তু কার্পেট শিল্পের টুকটাক কাজ, যেমন সুতা কাটা, রং করা বা নকশা তৈরি করে বহু পরিবার মাসে অতিরিক্ত ১৭০ ডলার আয় করে। এই বাড়তি আয় তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সাহায্য করে।
ইশতিয়াক বলেন, "সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হবে আমাদের গ্রামের মানুষ, শ্রমিক ও তাঁতিদের। যদি দুই দেশের সরকার কোনো সমাধানে না আসে, তাহলে তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।"