সমুদ্রের ৯ কিলোমিটার গভীরে বিচিত্র জগতের সন্ধান: পৌঁছায় না সূর্যের আলো, তবু প্রাণের মেলা

সমুদ্রের ৯ কিলোমিটারের বেশি গভীরে গিয়ে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন অদ্ভুত ও প্রতিকূল পরিবেশে গড়ে ওঠা প্রাণের অস্তিত্ব। তারা সেখানে ঝিনুকের বিছানা, বরফের মতো দেখতে ব্যাকটেরিয়ার চাদর ও কৃমি-জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণীতে ভরা বিশাল ক্ষেত্র দেখেছেন। এসব দৃশ্য তারা ভিডিও করেছেন এবং ছবি তুলেছেন।
এই অভিযানের নেতৃত্ব দেয় চীনের অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্সেস-এর ইনস্টিটিউট অভ ডিপ সি সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। তারা মনুষ্যচালিত একটি সাবমার্সিবলে করে উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর খাদে গিয়ে এই কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
এই অভিযানের আগে সবচেয়ে গভীর জায়গায় দেখা মেরুদণ্ডী প্রাণী ছিল একটি স্নেইলফিশ। ২০২৩ সালে প্রায় ৮ কিলোমিটার গভীরতায় জাপানের উপকূলবর্তী এক গভীর খাদে এটিকে সাঁতার কাটতে দেখা গিয়েছিল।
এমন গভীরতাতেও প্রাণ থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আগেই করেছিলেন। এই মিশনে অংশ নেওয়া গবেষকরা জানান, তাদের সাবমার্সিবলের জানালা দিয়ে যে বিপুলসংখ্যক প্রাণী দেখা গেছে, তা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।

এই বৈজ্ঞানিক মিশনটি প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে পরিচালিত হয়।
এতে ৫ হাজার ৮০০ মিটার থেকে শুরু করে ৯ হাজার ৫৩৩ মিটার গভীর খাদ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে প্রথমবারের মতো গভীর সমুদ্রে অক্সিজেনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে, এমনকি ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর খাদেও পাওয়া যায় প্লাস্টিকের ব্যাগ।
গবেষকরা যে সাবমার্সিবলটি ব্যবহার করেছেন, তার নাম 'ফেনদৌঝে'। এটি টানা কয়েক ঘণ্টা ১০ কিলোমিটারেরও বেশি গভীরতায় কাজ করতে পারে।

এ অভিযান সম্পর্কে গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ড. শিয়াওতং পেং বলেন, 'গভীর সমুদ্রের একজন বিজ্ঞানী হিসেবে এমন জায়গায় যাওয়া সত্যিই রোমাঞ্চকর। নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য এটি দারুণ সুযোগ। আর আমরা যা দেখেছি, তা এক কথায় ছিল অসাধারণ।'
বিজ্ঞানীরা যেসব দৃশ্য ধারণ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের তলায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর আধিপত্যে গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত জীববৈচিত্র্য। এই প্রাণীরা পুরোপুরি অন্ধকারে ও প্রচণ্ড চাপে বাস করে।
সেখানে যেহেতু সূর্যের আলো পৌঁছায় না, তাই এসব প্রাণী শক্তি সংগ্রহ করে সমুদ্র তলদেশ থেকে নির্গত রাসায়নিক উপাদান থেকে। পৃথিবীর ভূত্বকের ফাটল বা চিড় দিয়ে বেরিয়ে আসে হাইড্রোজেন সালফাইড ও মিথেন। এসব উপাদান থেকেই তারা শক্তি উৎপন্ন করে বেঁচে থাকে।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তারা এমন কিছু প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন যেগুলো আগে কখনও দেখা যায়নি। ভবিষ্যতের গবেষণায় তারা জানতে চান এসব প্রাণী কীভাবে এই রাসায়নিক উপাদানগুলোকে শক্তিতে রূপান্তর করে। এ ধরনের রাসায়নিক-নির্ভর প্রাণীদের 'কেমোসিনথেটিক' প্রাণী বলা হয়।
গবেষকদের মতে, এই প্রাণীসমূহ খুব একটা বিরল নয়। বরং সমুদ্রের গভীর জলে হয়তো তারা বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়েই ছড়িয়ে আছে। স্কটল্যান্ডের মেরিন সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু সুইটম্যান বলেন, 'এই আবিষ্কার দেখায়, মিথেন-নির্ভর বড় বড় বাস্তুতন্ত্র হয়তো সমুদ্রের গভীরতম অংশেও রয়েছে।'