‘প্যারেন্টহুড’: ডেভিড অ্যাটেনবরোর কণ্ঠে প্রাণীদের অভিভাবকত্বের অদ্ভুত সব গল্প

স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো,যিনি প্রকৃতির ভাষা বোঝেন, আর আমাদের শেখান সেই ভাষা বুঝতে। এই প্রাকৃতিক ইতিহাসবিদ এবার ফিরছেন নতুন এক শো নিয়ে, বিবিসি ওয়ানের সিরিজ 'প্যারেন্টহুড'। খবর বিবিসির।
এই সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে প্রাণীজগতের বাবা-মায়েরা কীভাবে সন্তানদের বড় করে তুলতে অকুণ্ঠভাবে লড়াই করে। কেউ খাবার জোগাড়ে দিনরাত পরিশ্রম করে, কেউ আবার নিঃস্বার্থভাবে নিজের জীবনও দিয়ে দেয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। প্রতিটি গল্পেই আছে আত্মত্যাগ, ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের নিখাদ ছবি।
এইসব গল্পে সবচেয়ে চমক জাগানো পর্বটি নামিবিয়ার আফ্রিকান সোশ্যাল স্পাইডারদের ঘিরে। সেখানে একটি মা মাকড়সা তার ছানাদের আগলে রাখে, যত্ন করে বড় করে। কিন্তু একসময়, সেই ছানারাই মাকে আক্রমণ করে। শুধু সে নয়, তার চারপাশের আরও বৃদ্ধ আত্মীয়দের ঘিরে ধরে তারা। তারপর ছানারা মিলে জীবন্ত খেয়ে ফেলে অভিভাবকদের।
এই নিষ্ঠুরতা নয়, বরং এটাই তাদের নিয়ম। এভাবেই নতুন প্রজন্ম জায়গা করে নেয় পুরনোদের সরিয়ে। এই প্রক্রিয়ার নাম ম্যাট্রিফেজি বা মাতৃভক্ষণ।
নিঃশব্দে, নির্মমভাবে, কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে ঘটে চলে এই জীবনচক্র। আর স্যার অ্যাটেনবরো সেই গল্পই বলে যান এমনভাবে, যেন প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
পরিচালক জেফ উইলসনের চোখে, এটিই ছিল "প্রকৃতির সবচেয়ে নিখুঁত দৃশ্যগুলোর একটি"। তিনি আরও বলেন, "আমি ডেভিডের বর্ণনা জীবনে যতবার শুনেছি, এটা তার মধ্যে সেরা।"
উইলসনের ভাষায়, "ডেভিড ঠিক জানেন কখন কী বলতে হবে। একজন পিতামাতা ঠিক কতদূর যেতে পারেন সন্তানের জন্য, সেটাই প্রশ্ন।"
হালকা হাস্যরস যোগ করে তিনি বলেন, "অবশ্যই আমি চাই না কোনো মানুষের মা-বাবা এভাবে আত্মত্যাগ করুক। তবে আমরা সবাই জানি, আপনি যদি সন্তানের বায়নার প্রিয় খাবারটি না দেন, তাহলে তারা আপনার ওপরই রাগ ঝাড়ে! তাই এটাও এক ধরণের শিক্ষা।"
অদ্ভুত বিস্ময়ে ভরা এক জগৎ
জেফ উইলসন জানালেন, এমন দৃশ্য ধারণ করতে হলে দরকার হয় বিশাল এক টিমের সম্মিলিত পরিশ্রম। বিজ্ঞানী, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজকেরা মিলে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছেন এই দৃশ্যগুলো ধারণে,কোন 'অহেতুক হস্তক্ষেপ' ছাড়াই ধরতে।

তিনি বললেন, "মাকড়শা ছানাগুলো চিনির দানার মতো ছোট। আর প্রাপ্তবয়স্করা একটা নখের আকারের।"
এই দৃশ্য দর্শকদের মধ্যে একইসঙ্গে গা শিউরে ওঠার অনুভূতি আর এক ধরনের বিস্ময় জাগিয়ে তুলবে বলে সতর্ক করেন উইলসন।
প্যারেন্টহুড সিনেমার সঙ্গে এই সিরিজের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটাও তিনি স্পষ্ট করেন। উইলসন আগেও স্যার ডেভিডের সঙ্গে বিবিসি ও সিলভারব্যাক ফিল্মসের আরেকটি সিরিজ 'দি মেটিং গেম' এ কাজ করেছিলেন। তখন থেকেই বুনো পরিবেশে মা-বাবার ভূমিকা নিয়ে কাজ করার এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তার মাথায় আসে।
তিনি বলেন, "বন্যপ্রাণীদের মধ্যে অভিভাবকেরা কতটা অভিযোজিত, সেটা দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হই। তারা আশ্চর্য রকমের সচেতন, পরিবেশ বদলাচ্ছে সেটাও তারা বোঝে।"
এই উৎসাহ থেকেই তিনি ছয়টি মহাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও জঙ্গলে, কখনও তৃণভূমিতে, কখনও বা সাগরের নিচে। খুঁজে বের করেছেন সেইসব প্রাণীদের, যাদের অভিভাবকত্ব আমাদের শেখায় বদল, প্রতিশ্রুতি আর সৃজনশীলতার পাঠ।
"বিশ্বটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে," বললেন তিনি। "জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জন্য যেমন হুমকি, তেমনি প্রাণীদের জন্যও। এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি এক অনিশ্চয়তার সামনে।"
"আমরা এই ধারণাটিকে ধরতে চেয়েছি মানুষ আর প্রাণী সবাই কেমন করে অভিযোজিত হচ্ছে এই নতুন পৃথিবীতে। এটা এখন আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।"
একজন পিতা হিসেবে উইলসনের নিজের মাঝেও থেকে যায় এক নিরব দুশ্চিন্তা। তিনি বলেন, "আমি প্রায়ই ভাবি, আমার সন্তানরা কেমন এক পৃথিবীতে বড় হবে?"
মা মাকড়সা তো আছেনই। তবে এই সিরিজে আছে আরও অনেক অনন্য চরিত্র। যেমন—
- ওরাংওটান মায়েরা, যারা দশ বছর ধরে সন্তানকে শেখায় কোন খাবার কীভাবে খেতে হয়
- বক্সার ক্র্যাব, যারা পানির নিচে এনিমোন ক্লোন করে অস্ত্র তৈরি করে, যাতে বাচ্চাদের শত্রুদের হাত থেকে বাঁচানো যায়
- মা হাতিরা, যারা নদী, খরা, আকস্মিক বন্যা, সব পার করে সন্তানকে টিকিয়ে রাখে
- এক বুড়ো মাছ, যে ঝরনার উল্টো দিকে উঠে বাসা বানায়, যদিও ততদিনে তরুণ সন্তানেরা তাকে পেছনে ফেলে যায়
- বিষধর ডার্ট ফ্রগ, যে এক একটা ছানাকে পিঠে তুলে বিশাল গাছ বেয়ে উঠে যায় নিচের জলাশয় থেকে গাছের মাথায় নিরাপদ পুকুরে। উইলসনের ভাষায়, "এই দৃশ্যটা যেন অ্যালেক্স হোনোল্ড এর ফ্রি ক্লাইম্বিং দেখার মতো।"
এই প্রাণীদের গল্প শুধু ক্লোজআপ ছবিতেই থেমে থাকে না। এইসব দৃশ্যকে আবেগে মোড়ানো এক সংগীতের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যান ব্রিটিশ কম্পোজার টম হাও। যিনি এর আগে মুলান আর টেড লাসোতেও কাজ করেছেন।
থিম সং গেয়েছেন স্যাম রাইডার। এটি রেকর্ড হয়েছে অ্যাবি রোড স্টুডিওতে। উইলসনের আশা, গানটি জনপ্রিয় হবে।
এই সব কিছুর কেন্দ্রে রয়েছেন এক পরিচিত কণ্ঠ, স্যার ডেভিড অ্যাটেনবরো। ৯৯ বছর বয়সেও তিনি এখনো দুইবারের বেশি টেক নেন না। এখনো তার কণ্ঠে মেলে বিশেষত্ব, আলাদা এক অনুভব।
উইলসনের মতে, "পৃথিবীতে খুব কম মানুষ আছে যারা ২ থেকে ১০২ বছর বয়সী দর্শকের সঙ্গে সমানভাবে কথা বলতে পারেন। ডেভিড সেই বিরল একজন।"
"আমরা যাকে স্ক্রিনে দেখি, তিনি শুধু সেখানেই নয়, বাস্তব জীবনেও তেমনই। আর যখন আপনার পাশে এমন কেউ থাকে, যে প্রকৃতিকে আপনিও যতটা বোঝেন, ততটাই বোঝে বা তার চেয়েও বেশি—তখন কাজ করাটাই হয়ে ওঠে এক রোমাঞ্চ।"
অভিভাবকত্বের নানা জটিলতা
জেফ উইলসনের চোখে প্যারেন্টহুড শুধু আরেকটা প্রাকৃতিক ইতিহাসের ধারাবাহিক নয়। এটি তার মতে এক "জেনারেশনাল গিফট"। এমন একটি উপহার, যা মা-বাবারা তাদের সন্তানদের সঙ্গে বসে দেখতে পারেন। দেখেও শিখতে পারেন।
"এই শো-তে সব আছে," বলেন তিনি। "আছে দারুণ আচরণ, গভীর আবেগ, হালকা রসবোধ আর মা-বাবাদের জন্য পরিচিত সব জটিলতা।"
এখানে এক চোখ মারে হেলিকপ্টার প্যারেন্টিংয়ের দিকে। আবার একবার চোখ টিপে দেয় সেই 'স্নোপ্লাও প্যারেন্টিং' নামক আধুনিক ধারণার দিকেও। মানে, আপনি কী ধরনের বাবা বা মা, সেটা নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো আমরা প্রায়ই আলোচনা করি, সেগুলোকেও এখানে জায়গা দেওয়া হয়েছে।

সবচেয়ে আনন্দের জায়গাটা উইলসনের জন্য ছিল আরও স্পর্শকাতর। তিনি বললেন, "এই শো-তে আমরা ধরতে চেয়েছি প্রকৃতির সবচেয়ে সংবেদনশীল সম্পর্ক—একজন অভিভাবক ও তার সন্তানের মধ্যে থাকা টান।"
এই সম্পর্ককে ধরার জন্য দরকার হয় ধৈর্য আর সংযম। কাজ করতে হয় মাঠে। বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখন ছবি তুলতে হবে, আর কখন শুধু তাকিয়ে থাকতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় খুব সতর্কভাবে।
উইলসন বলেন, "আপনি যদি কোনো শিকার দৃশ্য তুলে ধরেন, তাহলে অনেক সময় প্রাণীগুলো আপনার উপস্থিতি বোঝেই না। তারা নিজের মতো করে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু যখন আপনি প্যারেন্টিং আচরণ ক্যামেরাবন্দি করেন, তখন আপনি এমন কিছু নিয়ে কাজ করছেন যা খুবই স্পর্শকাতর।"
"একটুও ভুল হলে আপনি এমন একটা সীমারেখা পার করে ফেলেন, যেটা পার হওয়া উচিত নয়। সেই কারণেই আমরা পর্দায় যা তুলে ধরেছি, তা নিয়ে আমরা গর্বিত।"
এইসব মুহূর্তের মাঝেই ভেসে আসে অ্যাটেনবরোর পরিচিত কণ্ঠ। এক জায়গায় তিনি বলেন,
"প্রতিটি পিতামাতার সাফল্যের ফলই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ... কারণ সেটিই আমাদের গ্রহে জীবনের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখে।"
তাই যারা আমাদের আগলে রেখেছে, সেই পিতামাতাকে সম্মান করার বিকল্প নেই, আর এটাই যেন এই শো এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা