৭৪ বছরের লড়াইয়ের পর যেভাবে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণের লড়াইয়ে জিতলেন চীনা বিজ্ঞানীরা

চীনের হিমালয় অঞ্চলজুড়ে একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার সূচনা হয় প্রায় সাত দশক আগে।
১৯৫১ সালে চীনা সরকার চিংহাই-তিব্বত মালভূমি ঘিরে প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযানের আয়োজন করে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই অভিযানে অংশ নেয় ৫০ জনেরও বেশি গবেষক। তাদের সঙ্গে ছিল ব্যারোমিটার, কম্পাসসহ সীমিত সংখ্যক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।
তিন বছর ধরে চালানো এই অভিযানে তারা পূর্বের চিনশা নদী থেকে শুরু করে পশ্চিমে মাউন্ট এভারেস্ট পর্যন্ত এবং দক্ষিণ তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদী পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
অভিযানের সময় তারা একটি ভূতাত্ত্বিক জরিপ সম্পন্ন করে, যেখানে খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। সেই সঙ্গে সংগ্রহ করা হয় মাটি, আবহাওয়া, জলবিদ্যুৎ, কৃষি, ভাষা ও ইতিহাসসংক্রান্ত তথ্য।
সেই জরিপ থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে ইয়ারলুং সাংপো নদীতে একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাঁধ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিব্বতের নিয়িংচি শহরে। এখান থেকেই শুরু হয় এই 'ডাউনস্ট্রিম হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট'।
বিশ্বের এই সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাঁধ প্রকল্পে উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে ৬০,০০০ মেগাওয়াট, যা চীনের ইয়াংজি নদীর ওপর নির্মিত থ্রি গর্জেস ড্যামের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
২০১০ সালে সাউদার্ন উইকলি-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দ্বিতীয় তিব্বত অভিযান পরিচালনাকারী বিজ্ঞানী গুয়ান ঝিহুয়া বলেন, "ইয়ারলুং সাংপো চীনের সবচেয়ে উচ্চতম নদী। এটি ২,০৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা ইয়াংজি নদীর চেয়ে সামান্য কম হলেও দৈর্ঘের হিসাবে গণনা করলে এটাই দেশের শীর্ষ অবস্থানে।"
বর্তমানে আশি পেরিয়ে যাওয়া গুয়ান চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেসের অধীন ইনস্টিটিউট অব জিওগ্রাফিক সায়েন্সেস অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস রিসার্চ-এর সদস্য ছিলেন।
তবে ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকে চীনের 'গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড', দালাই লামার বিদ্রোহ ও পালিয়ে যাওয়া, ভারত-চীন সীমান্ত যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই গবেষণা কার্যক্রম থেমে যায়।
পুনরায় ১৯৭২ সালে এই গবেষণা শুরু হয়। ওই বছর চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেস চিংহাই-তিব্বত মালভূমির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক দল গঠন করে। সেই দলে গুয়ান ছিলেন ইয়ারলুং সাংপো নদী বিষয়ে নেতৃত্বে, যার কাজ ছিল নদীটির জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা নির্ধারণ করা।
পেশাগত জীবনে গুয়ান আরও ২২ বার তিব্বত গেছেন এবং ৯ বার ইয়ারলুং সাংপো নদীর গবেষণা অভিযান পরিচালনা করেছেন।
এই নদীটি মধ্য ও দক্ষিণ তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে গভীর গিরিখাত অতিক্রম করে, যার গভীরতা ৬ হাজার মিটার ছাড়িয়ে গেছে।
হিমালয় ও গ্যাংডাইস পর্বতমালার বরফাবৃত চূড়া থেকে জন্ম নিয়ে এই নদী পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব হিমালয়ে একটি বিশাল বাঁক নিয়ে নেমে আসে ভারতের আসামের পাসিঘাট অঞ্চলে। এখান থেকেই এটি নতুন নামে পরিচিত হয়, ব্রহ্মপুত্র।
১৯৮০ সালে চীনা কর্তৃপক্ষ সারা দেশে জলবিদ্যুৎ সম্পদের একটি সমীক্ষা শুরু করে, যার মধ্যে ইয়ারলুং সাংপো নদীও ছিল।
বৈজ্ঞানিক দলের পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী, ইয়ারলুং সাংপো নদীর মূল ধারায় প্রাথমিকভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রায় ১২টি সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করা হয়।
তবে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিব্বতের প্রাদেশিক সরকার নদীর মূলধারায় বাঁধ নির্মাণ ও পানি সরানোর জন্য দুই দফা চেষ্টা চালালেও অর্থ ও প্রযুক্তির ঘাটতির কারণে কোনো প্রকল্পই শুরু করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮১ সালে, গুয়ান ঝিহুয়ার সহকর্মী এবং একই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছেন ছুয়ানইউ তিব্বতের জলসম্পদ নিয়ে একটি বিশেষ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
তাতে তিনি প্রস্তাব দেন, ইয়ারলুং সাংপো নদীর মূলধারায় একটি জলাধার তৈরি করে পানির স্তর উঁচু করা হোক এবং তারপর একটি ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করে পানি সরিয়ে নেওয়া হোক ডুওশিওং নদীতে, যেটি একটি উপনদী এবং যেখানকার গভীরতা ২,৩০০ মিটারের বেশি।
"নিরাপত্তা ও পরিবেশের স্বার্থে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ভূগর্ভে নির্মাণ করা যেতে পারে," সেই সময় বলেছিলেন ছেন।
এরপর চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেস ধারাবাহিকভাবে ইয়ারলুং সাংপো নদীর জলসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গুয়াংমিং ডেইলি পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, শিরোনাম ছিল, "তিব্বতে কি বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়া সম্ভব?"
২০০২ সালে, ছেন 'ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স' জার্নালে একটি প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি ইয়ারলুং নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালুর সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব তুলে ধরেন। তিনি যুক্তি দেন, এই বিদ্যুৎ শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি করাই নয়, উচ্চ ভোল্টেজের মাধ্যমে গুয়াংডং ও হংকংয়েও পাঠানো সম্ভব হবে।
২০১৪ সালে সাউদার্ন উইকলি'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ছেন বলেন, "তখন এগুলো ছিল কেবল বৈজ্ঞানিক আলোচনা, অনেকটাই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। আমরা নিজেরাও এসব শুনে হেসে উঠতাম, বিস্তারিত কিছু ভাবিনি।"
কিন্তু বিশ বছর পর, সেই বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলিই আজ বাস্তব রূপ নিচ্ছে।
ইয়ারলুং সাংপো প্রকল্পের প্রকাশিত কারিগরি পরিকল্পনা, যেমন নদীর বাঁক সোজা করা, সুড়ঙ্গ দিয়ে পানি সরানো, পানির নিচে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং ক্যাসকেড বা ধারাবাহিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গঠন, সবই ছেনের আগের পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এইবার স্কেল অনেক বড়।
উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রধানত তিব্বতের বাইরে সরবরাহ করা হবে, তবে স্থানীয় চাহিদাও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অর্থের কোনো ঘাটতি আর নেই।
এই প্রকল্পের ব্যয় সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে চালাবে চীন। মোট ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১.২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (১৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার আগেই কয়েকটি সহায়ক প্রকল্প শুরু হয়ে গেছে।
চলতি বছরের ২৩ জুন, জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বত থেকে গুয়াংডং-হংকং-ম্যাকাও গ্রেটার বে অঞ্চলের মধ্যে একটি ±৮০০ কিলোভোল্ট 'আল্ট্রা হাই ভোল্টেজ ডাইরেক্ট কারেন্ট ট্রান্সমিশন প্রজেক্ট'–এর অনুমোদন দিয়েছে। এটি 'তিব্বত-গুয়াংডং ডিসি প্রজেক্ট' নামে পরিচিত।
এ বছরের মধ্যেই এর নির্মাণ পুরোদমে শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একবার প্রকল্পটি শেষ হলে, তিব্বত থেকে উৎপাদিত পরিষ্কার জ্বালানি "তাৎক্ষণিকভাবে" পৌঁছে যাবে গ্রেটার বে অঞ্চলে, এমনটাই বলা হয়েছে এনআরডিসি-এর প্রতিবেদনে।
ইয়ারলুং সাংপো একসময় চীনের শেষ প্রধান নদী ছিল, যেটিতে কোনো বাঁধ নির্মাণ হয়নি। তবে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে নদীর মাঝামাঝি অঞ্চলে অবস্থিত জ্যাংমু হাইড্রোপাওয়ার স্টেশন বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে।
এখন এটি তিব্বতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫১০ মেগাওয়াট, ইয়ারলুং সাংপো প্রকল্পে প্রত্যাশিত উৎপাদনের একশ ভাগের এক ভাগেরও কম।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা