রাজ্য নির্বাচনের আগে ভারতে চলছে মুসলিম উচ্ছেদ ও বাংলাদেশে পুশইনের অভিযান

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসামে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি এক কোণে নীল তেরপালে ঢাকা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে শত শত মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশু। রাজ্য নির্বাচনের আগমুহূর্তে সম্প্রতি তাদের নিজ ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহে এমন হাজার হাজার পরিবারের বসতবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। কয়েক দশকের মধ্যে এটাই আসামে সবচেয়ে বড় উচ্ছেদ অভিযান। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এসব পরিবার সরকারি জমিতে 'অবৈধভাবে' বসবাস করছিলেন।
বিশেষ করে গত বছর আগস্টে বাংলাদেশে 'ভারতপন্থী' আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই উচ্ছেদ অভিযান আরও জোরদার হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল আগামী বছরের শুরুতে পুনরায় ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে আসামে যেসব বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম—তাদের 'বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী' হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
'সরকার বারবার আমাদের হয়রানি করছে,' বলেন ৫৩ বছর বয়সী আরান আলি। আসামের গোলপাড়া জেলার এক খোলা জমিই এখন তার তিন সদস্যের পরিবারের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল।উত্তপ্ত জুলাইয়ের রোদে তার পলিথিনে ঢাকা বসতির চারপাশ ঝলসে উঠছিল।
'আমাদের দখলদার আর বিদেশি বলে অপবাদ দেওয়া হয়,' বলেন আসামে জন্ম নেওয়া আলি।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৪ হাজার ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে আসামে রয়েছে ২৬২ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরেই রাজ্যটিতে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বিরাজ করছে। আশঙ্কা, প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু ও মুসলিম অভিবাসীরা আসামের সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তুলবে।
তবে মোদির বিজেপি সরকার পরিচালিত সাম্প্রতিক যে দমন-পীড়ন কার্যক্রম চলছে তা শুধুমাত্র মুসলমানদের লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছে। এতে কয়েকদিন আগে এক কিশোরের মৃত্যু ঘটে, যার পর রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা—যিনি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দিয়ে দেশজুড়ে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত বিজেপি নেতাদের একজন—বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের জাতীয় পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলছে।'

সম্প্রতি এক্সে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, 'সীমান্ত পেরিয়ে লাগাতার মুসলিম অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আমরা নির্ভয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছি। এর ফলে ইতোমধ্যেই জনসংখ্যার ভারসাম্যে উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটেছে।'
গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সাংবাদিকদের বলেন, 'আসামের কয়েকটি জেলায় হিন্দুরা এখন নিজেদের জমিতেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার মুখে।'
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আসামের ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই মুসলিম অভিবাসী বলে দাবি করে তিনি বলেন, 'আর কয়েক বছরের মধ্যে আসামের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ শতাংশে পৌঁছাবে।'
এই বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া চাওয়া হলেও শর্মা কোনো মন্তব্য করেননি।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দীর্ঘদিন ধরেই মনে করে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতই হচ্ছে বিশ্বের সব হিন্দুর 'প্রাকৃতিক আবাসভূমি'। সে মোতাবেক দেশটির বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মোকাবেলায় নানা নীতি অনুসরণ করছে দলটি।
২০১৯ সালে বিজেপি সরকার ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে, যার ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত অনিবন্ধিত অমুসলিম অভিবাসীরা নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ পায়।
২০২১ সালের মে মাসে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে আসামের ১৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা থেকে উচ্ছেদ করেছে—যাদের বেশিরভাগই বাঙালি মুসলিম। প্রশাসনের ভাষ্য অনুযায়ী, আরও উচ্ছেদ অভিযান চলবে।
মাত্র এক মাসেই আসামের পাঁচটি এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানে প্রায় ৩ হাজার ৪০০টি বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে রাজ্য সরকার। এর আগে ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সালের শুরুর মধ্যে আগের সরকার পাঁচ বছরে প্রায় ৪ হাজার ৭০০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করেছিল।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রভীন দন্তি বলেন, 'আইনি অবস্থান যেমনই হোক, বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানরা এখন ভারতে দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে।'
ভারতের বিরোধী নেতারা অভিযোগ করেছেন, আসন্ন নির্বাচনের আগে ভোটব্যাংক মেরুকরণে এই উচ্ছেদ অভিযানকে হাতিয়ার করছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।
'এই ব্যবস্থা বিজেপির জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক ও সুবিধাজনক,' বলেন বিরোধী এমপি অখিল গগৈ।
মূল বিরোধী দল কংগ্রেস—যারা ২০১৬ সালের নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরে আসামে বিজেপির প্রথম সরকার গঠনের পথ করে দেয়—বলে দিয়েছে, ক্ষমতায় ফিরলে তারা গুঁড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করবে এবং যারা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তাদের জেলেও পাঠাবে।
'পুশব্যাক' অভিযান
এপ্রিল মাসে কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার ঘটনায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানের 'সন্ত্রাসীদের' দায়ী করে ভারত। যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। এরপর থেকেই বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় জোরালো হয়—তাদেরকে 'অবৈধ অভিবাসী' ও নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, যার জেরে ভারতজুড়ে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব আরও বেড়েছে। এই ক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ভোট কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলা, যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের প্রধান ভাষা, তা ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বিশেষ করে আসামের মতো রাজ্যগুলোতে।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আসামসহ কয়েকটি রাজ্যে শত শত বাঙালি মুসলিমকে বাংলাদেশে 'পুশব্যাক' (জোর করে পাঠানো) করা হয়েছে। তবে এদের মধ্যে অনেকে আবার ফেরতও এসেছেন, কারণ ভারতের আদালতে তাদের 'বিদেশি' ঘোষণার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আবেদন চলছে।
আসাম সরকারের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের ট্রাইব্যুনালগুলো এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে 'বিদেশি' ঘোষণা করেছে। অথচ এদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে সেখানেই বসবাস করছেন, পরিবারের পাশাপাশি তাদের রয়েছে জমিজমাও। অধিকারকর্মীদের অভিযোগ, এই মানুষদের অনেককেই ভুলভাবে বিদেশি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে এবং তারা এতটাই দরিদ্র যে, ট্রাইব্যুনালের রায় চ্যালেঞ্জ করার সামর্থ্য তাদের নেই।
নয়াদিল্লি ২০১৬ সালে জানায়, ভারতে প্রায় ২ কোটি 'অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী' বসবাস করছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, "ভারত সরকার কথিত অবৈধ অভিবাসীদের ধরার নামে হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে বিপদের মুখে ফেলছে। কিন্তু এই পদক্ষেপ আসলে মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক নীতিরই প্রতিফলন।"
চলতি বছরের মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য তারা ২,৩৬৯ জন ব্যক্তির একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে এবং তাদের পরিচয় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে ঢাকা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছে।
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে রয়টার্সের কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি।
শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার সংখ্যা বাড়তে থাকায়, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা প্রায়শই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে 'অনুপ্রবেশ প্রতিহত' করার ঘটনার ছবি ও বিবরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করছেন—যাদের ধরা হচ্ছে, তাদের ছবি পর্যন্ত প্রকাশ করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক প্রবীণ দন্তি বলেন, "আসামে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় জাতিগত জাতীয়তাবাদ এখন বিজেপির ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে 'বাঙালি ভাষাভাষী বহিরাগতদের' থেকে দৃষ্টি সরে এখন একান্তভাবে পড়েছে বাঙালি মুসলিমদের ওপর।"